অতিমাত্রায় স্মার্টফোন আসক্ত প্রি-স্কুল শিশুরাও, জানেন না অভিভাবকরা

স্মার্টফোন আসক্ত
স্মার্টফোন আসক্ত  © প্রতীকী ছবি

নোমোফোবিয়া বা স্মার্টফোনের অতিমাত্রায় আসক্তি  বলতে স্মার্টফোনের অনুপস্থিতে মানুষের অস্বাভাবিক আচরনকে বুঝায়। এই আসক্তিতে ব্যবহারকারীর মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ করে। এতে ব্যবহারকারী আনন্দবোধ করে এবং বেশি সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহারে উৎসাহিত হয়।

মোবাইল ফোনের এই আসক্তিতে আসক্ত দেশের প্রি-স্কুল শিশুরাও। যেখানে ৩ থেকে ৫ বছরের অধিকাংশ (৮৬%) প্রি-স্কুল বাচ্চারাই প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ ঘন্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কর্তৃক সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ সময়ের প্রায় ৩ গুন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ নাজমুল হক ও সহযোগী অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং আর টি এম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ফারুক আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে একটি গবেষকদল ৪০০ জন প্রি-স্কুল বাচ্চার মায়েদের কাছ থেকে জরিপকৃত তথ্য সংগ্রহ করে এমনটা দেখা গেছে।

জরিপে দেখা যায়, অধিকাংশ (৯২%) প্রি-স্কুল শিশু তাদের পিতামাতার স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং (৮%) শিশু তাদের পৃথক স্মার্টফোন ব্যবহার করে। এদের মধ্যে কার্টুন বা কল্পকাহিনী দেখার জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করে (৭৯%), গেম খেলার জন্য (৪৯%), টেলিভিশন/ভিডিও দেখা বা গান শোনার জন্য (৪৫%)।পক্ষান্তরে, শুধুমাত্র (১৪%) পড়াশোনার উদ্দেশ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে।

জরিপে আরও দেখা যায়, প্রায় ৮৬% স্মার্টফোনে আসক্ত প্রি-স্কুল বাচ্চাদের মধ্যে ২৯% এর মারাত্মকভাবে আসক্তি রয়েছে। কিন্তু প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে ৪ জনই স্মার্টফোনের আসক্তি সম্পর্কে অবগত নন। বাংলাদেশের প্রি-স্কুল বাচ্চারা স্মার্টফোনের আসক্তিতে ভুগছে বাবা-মা সন্তানদেরকে সময় কম দেওয়ার কারণে (৮৫%), খেলার মাঠের অভাবে (৫২%) ও খেলার সাথীর অভাবে (৪২%)।

আরও পড়ুন: বৃষ্টির আশায় মুসল্লিদের নিয়ে শায়খ আহমাদুল্লাহর ইসতিসকার নামাজ আদায়।

জরিপে, অবিভাবকরা কেন সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেন এই প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশ (৭৩%) মা বলেছেন তাদের নিজের কাজে ব্যাঘাত না ঘটাতে বাচ্চাদের স্মার্টফোনের সাথে ব্যস্ত রাখতে এটা করেন, ৭০% মা তাদের বাচ্চাদের স্মার্টফোন দেন কারণ তাদের বাচ্চারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পছন্দ করে, ৬৭% মা তাদের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য এবং ৩১% মা শিশুকে ঘুম পারানোর জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করেন।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, মা ও বাবার প্রতিদিনের স্মার্টফোনের ব্যবহারের মাত্রাও তাদের সন্তানদেরকে স্মার্টফোনে আসক্ত করতে উৎসাহিত করে। যেসব মা ও বাবা প্রতিদিন ৩ ঘন্টা বা তার বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের সন্তানরা স্মার্টফোনে আসক্ত হওয়ার সম্ভবনা প্রায় ৯০ গুণেরও বেশি। তদুপরি, পেশাজীবী মায়েরা তাদের বাচ্চাদের পর্যাপ্ত সময় দিতে না পারায় অধিকহারে স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে শিশুরা। এছাড়া, অধিক আয়ের পরিবারের (মাসিক ২৫০০০ টাকা বা তার বেশি) বাচ্চারা অধিক হারে স্মার্টফোনে আসক্ত।

গকেষকরা মনে করছেন, স্মার্টফোনের আসক্তি বাচ্চাদের বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ। যেমন ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন, কারণ ছাড়াই রেগে যাওয়া, অপর্যাপ্ত এবং অনিয়মিত ঘুম, অমনযোগীতা, ভুলে যাওয়া, ভাষার দক্ষতা বিকাশ না হওয়া এবং পিতামাতা ও খেলার সাথীদের সাথে বিছিন্নতা। স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চারা স্মার্টফোনে আসক্ত নয় এমন বাচ্চাদের তুলনায় ৫০০ গুণ বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিতে আছে।

একই সাথে নানা রকম শারিরীক সমস্যার কথাও উঠে এসেছে এই গবেষণায়। যেমন স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চারা সচরাচর মাথাব্যথা, হাত ও পিঠে ব্যথা, ক্ষুধা হ্রাস, অনিয়মিত খাবারের সময়, ওজন এবং উচ্চতার অসামঞ্জস্যপূর্ণতা এবং শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ভোগে। স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চাদের শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকি স্মার্টফোনে আসক্ত নয় এমন বাচ্চাদের তুলনায় ২৩০ গুণ বেশি। তবে প্রতি ১০ জনে ৫ জন মা-ই বিশ্বাস করেন তাদের সন্তান স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনেক কিছুই শিখতে পারে।

প্রি-স্কুল শিশুদের স্মার্টফোনের আসক্তি নিয়ে অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ নাজমুল হক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বাচ্চাদের ৩ থেকে ৫ বছর সময়ের মধ্যেই  মস্তিষ্কের বিকাশ হতে থাকে। এসময়টা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। স্মার্টফোনের আসক্তি শিশুদের মধ্যে বিষন্নতা, উদ্বেগ, অসামাজিক এবং বিপজ্জনক আচরনজনিত সমস্যার প্রকাশ ঘটায়।  এটি তাদের মানসিক, শারীরিক এবং জ্ঞান বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। 

তিনি বলেন, অভিভাবকদের উচিৎ তাদের প্রি-স্কুল সন্তানদের প্রস্তাবিত সময়ের বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে না দেওয়া, তাদের সাথে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করা এবং তাদের খেলার সাথী ও পরিবেশ নিশ্চিত করা। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্মার্টফোন আসক্তির বিরুপ প্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারবে।


সর্বশেষ সংবাদ