বুদ্ধিবৃত্তির পঞ্চাশ বছর কি কেবলই পিছিয়ে যাওয়ার?

অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. কাজী খলীকুজ্জমান ও অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ
অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. কাজী খলীকুজ্জমান ও অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ  © টিডিসি ফটো

“বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাঙলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না। আগে বৃদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়-প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালী হয়েছেন-সেও ঠেলায় পড়ে। কলাবরেটরদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা অন্ধভাবে হলেও ইসলাম পাকিস্তান ইত্যাদিতে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাঙলাদেশে চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যারা সারা জীবন কোনো কিছুতে যদি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন-সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ”— সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থা নিয়ে পাঁচ দশক আগে এমনটাই লিখেছিলেন লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা। পাঁচ দশক পেরিয়ে সমাজের খোলস কাঠামোর আয়নায় তাকালে কতটুকু উন্নতি লক্ষ্য করা যায় বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতিতে?

পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমান বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন; এদের মধ্যে দেশে বর্তমানে স্বাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ বলে সর্বশেষ জানানো হয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রথম ডিজিটাল ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে দাঁড়িয়ে দেশের আর্থিক, সামাজিক,  রাজনৈতিক নানা সূচকে উন্নতি হলেও কতটুকু উন্নতি হয়েছে দেশের সামগ্রিক গুণগত শিক্ষায় ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নে-সে প্রশ্নের জবাব কেবলই হতাশার।

দেশের শিক্ষা ও তৎসংশ্লিষ্ট খাতে উন্নতির মাপকাঠি বিচার করলে শিক্ষার পরিমাণগত উন্নতি হলেও গুণগত উন্নতি খুব বেশি হয়নি-বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও সরকার বর্তমানে প্রতিবছর বিনামূল্যে প্রায় ৩৫ কোটি বই দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এছাড়াও পিছিয়ে পড়া বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা নিশ্চিত করতে বৃত্তি ও উপবৃত্তিসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে। যা শিক্ষার  সার্বিক সূচকের উন্নতিকে উর্ধ্বমূখী করলেও নিম্নমুখী হচ্ছে দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির সূচক। ফলে আরও প্রশ্ন সংযুক্ত হয় আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি কি তবে কেবলই কথার কথা?

আরও পড়ুন: অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা: মেধা আর অর্থ দুটোরই অপচয়

দেশে বর্তমানে শিক্ষা কেবলই চাকরি পাওয়ার মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। যার ফলে তারুণ্যের হতাশা আর বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির বেহাল দশা। যার প্রমাণ বর্তমানে আমাদের পাঠ্যক্রমে পড়ানো হচ্ছে বা জোর দেয়া হচ্ছে এমন সব বিষয়ে যাতে সহজে চাকরি পাওয়া যায়।

একশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আর্থ-সামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তাঁরা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। এছাড়াও চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ। 

পরিসংখ্যানের তথ্য মতে, পাঁচ দশকের একটি পরিণত বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। আর এ সময়ে আমাদের জনমিতিতে যে পরিবর্তন, তার সুফল পেতে আমাদের বর্তমান তরুণদের জন্য জন্য আশা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমাদের সামাজিক ও আর্থিক কাঠামোয় শক্তিশালী ভিত দাঁড় করাতে হলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বৃদ্ধি করতে হবে আমাদের প্রচলিত দক্ষতারও। জনমিতিতে পরিবর্তন ও সময়ের সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের আজকের প্রজন্মকে বর্তমানের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ বেশি দক্ষ হতে হবে স্বাভাবিকভাবেই। তাই সংশ্লিষ্টরা মনে করেন উন্নতি নিশ্চিত করতে হবে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাসে।

আমাদের সকল স্তরের শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। যার ফলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাস কাঙ্ক্ষিত হয়নি জানিয়ে লেখক, প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষার গুণগত মান আমরা বাড়াতে পারিনি; পরিমাণগত বাড়িয়েছি। এর নিদর্শন হলো যারা আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে ত্রুটি রয়ে গেছে। যেমন ইতিহাসের চর্চা কমে গেছে; ইতিহাসকে কোনো গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে এটা শুধুমাত্র একটি সমাজবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ ইতিহাস একটি জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধুমাত্র তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যই নয় বরং ইতিহাসে একটি জাতির অর্জন, তার গৌরব, তার ব্যর্থতা সবকিছুই তার ইতিহাসের অংশ। বর্তমান শিক্ষা-ব্যবস্থায় বা কাঠামোয় ইতিহাস পাঠকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।

পাশাপাশি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি না হওয়ার আরেকটি কারণ বর্তমানে সাহিত্যকেও গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না বলে মনে করেন প্রবীণ এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ইতিহাসের পাশাপাশি সাহিত্যকে গুরুত্ব না দেয়া আমাদের শিক্ষার জন্য খুব খারাপ হচ্ছে। এর ফলাফল হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতিতে পিছিয়ে যাওয়া-যুক্ত করেন অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি সমাধান হিসেবে মনে করেন আমাদের শিক্ষানীতিতে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাড়াতে হবে ইতিহাসও সাহিত্যের মতো বিষয়গুলো; ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে হবে। যাতে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি নিশ্চিত করা যায়।

আরও পড়ুন: জানুয়ারিতে ২ সেমিস্টার চালুর সিদ্ধান্তে হিতে বিপরীতের শঙ্কা

আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতির জন্য সামগ্রিক সচেতনতা দরকার জানিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কমিটি ও শিক্ষা আইন প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের যেসব আলোকবর্তিকাদের আমরা হারিয়েছি, তাদের আমরা ফেরত পাবো না। আপনাকে মনে রাখতে হবে শিক্ষা অর্থনীতি বিযুক্ত নয়; শিক্ষা দেশপ্রেম বিযুক্ত নয়। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি যতটুকু হওয়ার দরকার ততটুকু হয়নি। সেজন্য আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা-ব্যবস্থাপক ও শিক্ষা প্রশাসকদের সামগ্রিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন করতে হবে বলে মনে করেন দেশের শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের প্রবীণ এই নেতা।

তিনি আরও বলেন, শিক্ষা শুধুমাত্র তো জীবিকা অর্জনের বিষয় নয়; আবার এর সাথে দেশপ্রেমও বিচ্ছিন্ন নয়। শিক্ষা একটি সামগ্রিক বিষয়। বর্তমানে শিক্ষা বিশ্বজনীন সেটাকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন। আমাদের উন্নয়ন হয়েছে, তবে তাই বলে আপনার বসে থাকার সুযোগ নেই। কারণ, একই সময়ে বিশ্ব আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে বা যাচ্ছে। তাই আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে; আপডেটেড থাকতে হবে। মূলকথা হলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতিতে কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে-যুক্ত করেন তিনি।

অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান মনে করেন, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি নিশ্চিত করতে হলে আমাদের তরুণদের সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের শিক্ষার সম্প্রসারণ হয়েছে; তার পরিমাণও বেড়েছে এখন আমাদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেটার সবদিক বিবেচনায় ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি বলেন, শিক্ষারও তো একটি ফল আছে; আর্থিক মূল্য আছে, সেটা অনেকটা চাহিদাভিত্তিক হয়েছে। যার ফলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি আড়াল হয়েছে।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আরও বলেন, আমাদের সকল ক্ষেতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সাথে নিয়ে চলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থাৎ আমাদের সকলকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, তরুণদের সময়ের চাহিদার সাথে দক্ষতা উন্নয়নের পাশাপাশি তাদের নৈতিকতাও বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের উন্নতি হয়েছে তবে তাকে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিতে হলে আমাদের আরও কাজ করতে হবে। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নতি হলে তো হবে না; আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতিও নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।


সর্বশেষ সংবাদ