‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য ট্রেনিং ইউজিসি’র উদ্ভট চিন্তা’

কামরুল হাসান মামুন
কামরুল হাসান মামুন   © টিডিসি ফটো

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মানোন্নয়নে ইউজিসির নেতৃত্বে একটি ‘ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি’ খোলা হচ্ছে। তার আওতায় চলতি বছরের অক্টোবর মাসে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

মারহাবা! মারহাবা!! মারহাবা!! সংবাদটি পড়ে আমি হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারছি না। আমার ধারণা যারা এইসব ভাবছেন তারা সরকারি কর্মকর্তা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মানে গুলিয়ে ফেলছেন। আমি কেবল ভাবছি আমাদের উচ্চ শিক্ষায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই সিদ্ধান্ত তাদের মানের একটা প্রতিফলন। পৃথিবীর কোথাও কি এইরকম একাডেমী আছে? আসলে ইউনিভার্সিটি টিচারদের ট্রেনিং কি এইটাই আমাদের শিক্ষক নেতারা বুঝেন না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ট্রেনিং হলো পিএইচডি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ট্রেনিং হলো পোস্ট-ডক করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ট্রেনিং হলো বক্তা কিংবা অংশগ্রহণকারী হিসাবে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যাওয়া এবং আয়োজক হওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ট্রেনিং হলো বড় বড় গবেষকদের অধীনে গবেষণার অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করা। এইসবের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে নিজের একটি ধারা তৈরী করে ফেলেন। 

আরও পড়ুন: কেউ বোরখা পড়বে, কেউ স্কার্ট-স্লিভলেজ ব্লাউজ— এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য

এই যে একজন সুপারভাইজরের অধীনে ৩ বছর ব্যাপী পিএইচডি করলাম এইটা একটা বিশাল ট্রেনিং। এই যে আমি ১ বছর ৮ মাস একজন খ্যাতিমান একজন গবেষকের অধীনে পোস্ট-ডক করলাম এবং সেই সুবাদ বিশ্বের অন্যান্য দেশের পোস্ট-ডকদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম এইটা ট্রেনিং। এই যে আমি বিশ্বের নানা দেশে বিভিন্ন কনফারেন্সে বক্তা কিংবা অংশগ্রহণকারী হিসাবে যোগ দেই এইটা ট্রেনিং। এইসবের মাধ্যমে বিশ্বসেরা শিক্ষক বা গবেষকরা কিভাবে লেকচার দেয়, কিভাবে কথা বলে, কিভাবে চিন্তা করে ইত্যাদি আমরা শিখি। এর চেয়ে বেটার কোন ট্রেনিং হতে পারে না। এইসব বাদ দিয়ে একটা ট্রেনিং একাডেমীর মাধ্যমে ট্রেনিং দিয়ে শিক্ষকদের ছকে বেঁধে দেওয়ার চিন্তা খুবই খারাপ কাজ হবে।  

বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে ছকে বাঁধা প্রোগ্রাম দিয়ে কিভাবে লেকচার দিতে হয় শেখানো উচিত না তাতে স্বকীয়তা এবং ডাইভারসিটি থাকে না। আমি যে জীবনে এত এত বিশ্বমানের গবেষকদের লেকচার শুনলাম তাদের কারো লেকচার কারো সাথে মিলে না। একদম না। আমাদের এইখানে এইসব ভাবনা কেন আসে? কারণ আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেই না। আমরা দেই শিক্ষানবিশ শিক্ষক নিয়োগ দেই। কারণ বিশ্বের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন আর মাস্টার্স পাশ ডিগ্রী দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে না।

মাত্র কয়েকদিন আগেই ভারতের আইআইটির একটি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি নিয়ে স্টেটাস লিখেছিলাম। সেখানে ন্যূনতম যোগ্যতা শুধু পিএইচডি না। পিএইচডি ডিগ্রীর পর ন্যূনতম ৩ বছরের পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। কারণ পিএইচডি এবং পোস্ট-ডক্টরাল সময়ের কাজের মাধ্যমেই প্রমান হয়ে যায় প্রার্থী বুকিশ বা মুখস্ত শক্তি দিয়ে অনার্স মাস্টার্সে ভালো রেজাল্ট করে সার্টিফিকেট অর্জন করেছে নাকি তার মধ্যে সত্যিকারের সৃজনশীল মন তৈরী হয়েছে।  পিএইচডি এবং পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতাই হলো একজন প্রার্থী কত ভালো গবেষক তার আসল নির্ণায়ক। 

একজন মাস্টার্স পাশ প্রার্থী নিয়োগ দিলে বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে huge risk নেয়। যেমন কেবল মাস্টার্স পাশ কাউকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিলে ভবিষ্যতে কোনদিন তার পিএইচডি ডিগ্রী নাও হতে পারে। কোন রকমে পিএইচডি হলেও কোন পোস্ট-ডক ফেলোশিপ নাও পেতে পারে। পিএইচডি করার জন্য স্কলারশিপ নাও পেতে পারে। তখন মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তাকে পিএইচডি করানোর প্রয়োজন হতে পারে।

আবার পিএইচডি কালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে পূর্ন বেতনে ছুটি দিতে হয় কিন্তু শিক্ষক পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে নাও আসতে পারে। এতেও বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

যেই টাকা দিয়ে আমাদের ইউজিসি ট্রেনিং একাডেমী করবে এবং বছর বছর এর পেছনে নানা ভাবে খরচ করবে এইটা টোটাললি একটা অপচয়। এই টাকা দিয়ে শক্ত পিএইচডি প্রোগ্রাম নেওয়া যায়, পোস্ট-ডক নিয়োগ দেওয়া যায়। ইউজিসি একটা কাজ করতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলকে অটোমেশন করার সফটওয়্যার তৈরী করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিতে পারে।

আরো অনেক ক্ষেত্রেই টাকা খরচ করা যায়। কিন্তু for god sake ট্রেনিং একাডেমী করে খরচ করবেন না। এইটা হাস্যকর। বরং প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত কনফারেন্সের আয়োজন করুন, শিক্ষকদের বিদেশে আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিতে আর্থিক সহযোগিতা দিন। সরকারকে ট্যাক্সের টাকায় পিএইচডি করতে পাঠানো বা পোস্ট-ডক করতে পাঠানো কাজ না। বরং ওই টাকায় শক্তিশালী পিএইচডি প্রোগ্রামের মাধ্যমে দেশেই পিএইচডি করার সুযোগ তৈরী করুন। তখন যারা যোগ্য তারা পিএইচডি ফেলোশিপ পাবে। সেইটা দেশি কিংবা বিদেশী ফেলোশিপ হতে পারে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ট্রেনিং দিয়ে কি শেখাবেন? নৈতিকতা? সিভিক সেন্স? এইসব ছোটবেলা শেখার বিষয়। এই বুইড়া বয়সে কেউ নৈতিকতা শিখতে পারে না। তাহলে ট্রেনিং দিয়ে কি শেখাবেন? কিভাবে লেকচার দিতে হয়? ওটাও  একটা গুরুবিদ্যা যেমন গান শেখা, ছবি আঁকা, গবেষক হওয়া ইত্যাদি। এইসব ক্ষেত্রে একজন গুরু থাকতে হয় যার অধীনে অনেকদিন কাজ করে শিখতে হয়।

গুরু মানে সুপারভাইজরের সাথে কাজ করে, সুপারভাইজরের সহকর্মীদের সাথে কাজ করে, অন্যান্য পিএইচডি ও পোস্ট-ডকদের সাথে কাজ করে একজন matured হয়। দুই মাস ছয় মাসের ট্রেনিং কারা দিবে? আমি নিশ্চিত আমাদের শিক্ষা ক্ষেত্রে যারা নেতৃত্ব দেয় তারাই ট্রেনিং দিবে। আমিতো মনে করি তাদের ট্রেনিং দেওয়ার যোগ্যতাই নেই। বরং তাদেরই ট্রেনিং এর প্রয়োজন। কিন্তু বয়স তাদের প্রতিকূলে। তাদেরকে ট্রেনিং দিয়েও ভালো করা সম্ভব না। আশা করি আমাদের ইউজিসি ও নীতিনির্ধারকরা এইরকম উদ্ভট চিন্তা থেকে দ্রুত সরে আসবে।

ফেসবুক থেকে...

লেখক- অধ্যাপক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। 


সর্বশেষ সংবাদ