সুপেয় পানি, সুশাসন এবং টেকসই উন্নয়ন: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

ড. মুহাম্মদ বদরুল হাসান
ড. মুহাম্মদ বদরুল হাসান  © টিডিসি ফটো

সুপ্রাচীনকাল থেকে মানবসভ্যতা সমূহ গড়ে উঠেছে পানির উৎসগুলোকে কেন্দ্র করে। টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস, হোয়াংহো কিংবা সিন্ধু নদীর অববাহিকায় সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল পানির পর্যাপ্ত জোগানের কারণেই। এসব উৎসের পানি পান অযোগ্য না হলেও সবসময় যে তা নিরাপদ ছিল, তাও বলা যাবে না। দূষিত পানি পানে নানান পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে জনপদের পর জনপদ উজাড় হয়ে যাওয়ার নজির তাই অচেনা কিছু নয়।

কালের বিবর্তনে সেসব প্রাচীন জনপদ থেকে বর্তমান বিশ্বের আধুনিকতার মোড়কে মোড়ানো শহরগুলোও আজ পানির সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। কিছু শহর তো ইতিমধ্যে প্রায় পানি শূন্য হওয়ার অবস্থা। তালিকায় যুক্ত হয়েছে কেপটাউন, লন্ডন, জাকার্তা, সাওপাওলোর মতো শহরের নাম!

একুশ শতকের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় দৈনন্দিন জীবনের সকল চাহিদা পূরণের সহজলভ্যতার মাঝে যখন জানা যায় বিশ্বের প্রায় ৭৭ কোটি ১০ লক্ষ (ডব্লিউএইচও এবং ইউনিসেফ যৌথ পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি, ২০২১) মানুষই সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত তখন বিশ্বাস করতে সত্যিই কষ্ট হয়। বর্তমান বিশ্বে প্রতি ১০ জনে ১ জন যখন সুপেয় পানির অভাবে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তখন সমাজের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলা প্রথম ৫টি বৈশ্বিক ঝুঁকির একটি ঘোষণা করেছে বিশুদ্ধ পানি সংকটকে।

আরও পড়ুন : মেয়র ভাই, আর কতো বৈষম্য সৃষ্টির বাণী দিবেন: আসিফ নজরুল

বাংলাদেশও এই বিশুদ্ধ পানির সংকট থেকে মুক্ত নয়। জনসংখ্যার আধিক্য, দ্রুত শিল্পায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই সংকট দিনদিন আরও প্রকট আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ’ (২০২০) অনুযায়ী দেশের ৪১ জেলার ১৯২টি উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট।

জাতিসংঘ শিশু তহবিল (২০২০) এর ভাষ্যমতে দেশের প্রায় ৬ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের কাছেই নেই সুপেয় পানির নিশ্চয়তা। অপরিকল্পিত নগরায়নও শিল্পকারখানার কার্যক্রমের ফলে নগরের ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। নলকূপের মাধ্যমে এসব নগরীর বেশিরভাগ মানুষের পানির চাহিদা মেটানো হলেও পরিশুদ্ধকরণ ব্যতীত এ পানি পান করা প্রায় অসম্ভব। এক্ষেত্রে দেশের প্রান্তিক ও উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠীর অবস্থা আরও শোচনীয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্র পৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ক্রমেই তা লোকালয়ে প্রবেশ করছে। ফলে সেসকল এলাকার সুপেয় পানির উৎসসমূহ নষ্ট হচ্ছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে খাবার পানির সংকট। স্থানীয় এনজিও ‘উত্তরণ’ এর রিপোর্ট (২০১৯) অনুযায়ী বাগেরহাটের এক মোংলা উপজেলায় ৬৭ শতাংশ পরিবার আছে সুপেয় পানির সংকটে। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটের বেশকটি উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে কমবেশি প্রায় ৫০ লাখ মানুষ খাবার পানির সংকটে রয়েছে।

সংকট যেখানে রয়েছে সমাধানের হাতছানি সেখানে অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। সুপেয় পানির এই তীব্র সংকট নিরসনে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেয়া হচ্ছে নানান উদ্যোগ। দেশের শহরাঞ্চলে খাবার পানি সমস্যা নিরসনে স্থানীয় সরকারের আওতাধীন ঢাকা ওয়াসা সহ অন্যান্য ওয়াসাগুলো বেশকিছু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করছে। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রাম ওয়াসার নতুন একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপনের কাজ উদ্বোধন করেন।

আরও পড়ুন : আমরা মানের চেয়ে সংখ্যা বাড়ানোয় এক্সপার্ট জাতি

দেশের গ্রাম পর্যায়ে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা সমূহ সরকার ও বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর অর্থায়নে স্থাপন করছে নলকূপ, বায়োসেন্ড ফিল্টার, পিএসএফ, রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং, রিভার্স অস্মোসিস, মারপ্লান্টের মতো প্রযুক্তিগত অবকাঠামোসমূহ।

পাশাপাশি নেয়া হচ্ছে জলাধার নির্মাণ ও সংস্কার প্রকল্পসমূহ। তবে এসকল অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রকল্প হাতে নেয়ার পরও দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনও সুপেয় পানির প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সব অবকাঠামো সমূহের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য যে টেকসই রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন তা আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না। অর্থাৎ স্থাপনের কিছুদিন পরই যথাযথ পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবকাঠামোগুলো অকেজো হয়ে পড়ছে।

পানি বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে এসকল খাবার পানির অবকাঠামোর টেকসই সেবা নিশ্চিত করতে তিনটি বিষয়ের উপর সমানভাবে নজর দেয়া জরুরি যেমন: ১) প্রযুক্তির মান ২) ভূতাত্ত্বিক অবস্থান ও ৩) সুশাসন তথা সঠিক ব্যবস্থাপনা।

অথচ বাংলাদেশে প্রথম দুটি বিষয় অর্থাৎ প্রযুক্তিগত দিক ও ভূতাত্ত্বিক পর্যালোচনার উপর জোর দেয়া হলেও, দুর্ভাগ্যবশত সুশাসনের উপর কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট এলাকার ভূতাত্ত্বিক সম্পদ কিংবা সামগ্রিক দিক বিবেচনায় রেখে সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহারে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হলেও সরকার কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুশাসনের উপর গুরুত্ব আরোপের অভাবে প্রকল্পগুলো কিছুদিন যেতে না যেতেই তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এক গবেষণায় পাওয়া যায় যে শুধু সুশাসনের অভাবে ৩০-৪০% কমিউনিটি-ভিত্তিক খাবার পানির অবকাঠামোসমূহ স্থাপনের কিছুদিন পরেই অকেজো হয়ে পরছে।

পানি সুশাসন বলতে বোঝায় একগুচ্ছ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক নিয়ম-কানুন ও প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে পানি অবকাঠামো সমূহ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। নব্বই দশক থেকে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও খাবার পানি সুশাসনের তথা সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য ‘কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট’ মডেল অনুসৃত হয়ে আসছে।

এই মডেল অনুযায়ী দেশের গ্রাম ও উপশহর পর্যায়ে খাবার পানির সরবরাহের উদ্দেশে সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাসমূহ যে অবকাঠামো স্থাপন করে সুবিধাভোগীর নিকট হস্তান্তর করে দিয়ে আসে সুবিধাভোগীগণ পরবর্তীতে তা নিজেরা যৌথভাবে পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করে। সম্প্রতি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পরিচালিত আমার এক গবেষণায় খাবার পানি অবকাঠামো সমূহ টেকসই না হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ‘কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট’ মডেল এর সীমাবদ্ধতাসমূহ উঠে আসে।

গবেষণায় পাওয়া যায় যে সরকার বা কোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে যখন এসব খাবার পানির অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হয় তখন সেখানে শুরু থেকেই জনসাধারণের সম্পৃক্ততার বিষয়টি খুব একটা আমলে নেয়া হয় না। ফলস্বরূপ সেই উদ্যোগের উপর একদিকে মানুষের যেমন সঠিক জ্ঞান থাকেনা তেমনি অন্যদিকে জনসাধারণ এগুলোকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারেনা। এতে করে স্থাপিত অবকাঠামোগুলোর প্রতি জনসাধারণকে খুব একটা যত্নশীল বা রক্ষণাবেক্ষণে আগ্রহী হতে দেখা যায় না।

আবার অন্যদিকে, রাজনৈতিক মতাদর্শগত পার্থক্য, স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রাধান্য, অসম আর্থসামাজিক মর্যাদা প্রভৃতির কারণে পানির অবকাঠামো পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে জনগণের মাঝেও যৌথ প্রয়াস খুব কম দেখা যায়। তাই অবকাঠামোগুলোও কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে এবং ফলে সুপেয় পানির টেকসই সমাধান নিশ্চিত হচ্ছে না। পানির  অবকাঠামোসমূহ টেকসই হওয়ার উদ্দেশে পরিচালিত আমার এক গবেষণায় “কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট প্লাস” মডেলটি তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে পাওয়া যায়।

আলোচ্য মডেলটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে সুবিধাভোগী জনগণ সম্মিলিতভাবে সরকার বা বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় (যেমন: যথাযথ তদারকি, প্রশিক্ষণ প্রদান, মেরামত কাজে আর্থিক সহায়তা, প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন) খাবার পানির জন্য নির্মিত অবকাঠামোর সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। মডেলটি সর্বদাই সরকার, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দাতাসংস্থা, উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান এবং জনসাধারণের সমষ্টিগত উদ্যোগকে উৎসাহিত করে।

আরও পড়ুন : ‘ছুটির ঘণ্টা’ দেখে বহু মাস স্কুলের টয়লেট ব্যবহারের সাহস পাইনি

গবেষণায় পাওয়া যায় যে, পানি সুশাসনের  ক্ষেত্রে “কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট প্লাস” মডেলটি  বাস্তবায়ন করতে গেলে একদিকে যেমন পানির অবকাঠামোটি পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উপকারভোগী জনগণের মাঝে যৌথভাবে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে, অন্যদিকে তাদের ঐ যৌথ কাজটিকে উৎসাহিত এবং চলমান রাখতে নিশ্চিত করতে হবে সরকারি অথবা বেসরকারি সংস্থার পক্ষ হতে নিয়মিত সহযোগিতাও, হোক সেটা আর্থিক সহযোগিতা, প্রশিক্ষণগত সহযোগিতা কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা।

তাছাড়া, সরকার বা কোনো বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা থেকে যখন কোনো প্রযুক্তিনির্ভর বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হবে তখন শুরু থেকেই জনসাধারণকে সম্পৃক্ত ও সচেতন করতে হবে। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে।

শুধু প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যেই তাদের দায়িত্বকে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না বরং কাজ করতে হবে জনসাধারণের মধ্যে এসব প্রকল্পের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান প্রদানের মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি ও রক্ষণাবেক্ষণে উৎসাহী করে তুলতেও। নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জনসাধারণকে সহায়তা করতে হবে। কেননা জনসাধারণকে উদ্যোগী করে তুলতে না পারলে দিন শেষে সংকট মোকাবিলা সম্ভব না।

বর্তমান সরকার ও জনগণের জন্য সুপেয় পানি নিশ্চিতকল্পে বদ্ধ পরিকর। তাই, সরকার জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯), বাংলাদেশ পানি আইন (২০১৩) এ স্পষ্ট ভাষায় নিরাপদ পানির অধিকারকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

তাছাড়া, সরকার ২০১৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সমূহ (এসডিজি) গ্রহণ করেছে এবং বিশেষ করে এসডিজি’র ৬ নম্বর লক্ষ্য (২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সকল জনসাধারণের জন্য নিরাপদ ও সহজলভ্য সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা) পূরণে সরকার ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে।

আমি বিশ্বাস করি “কমিউনিটি ম্যানেজমেন্ট প্লাস” মডেলটির যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা যদি পানি সুশাসন নিশ্চিত করতে পারি এবং জনসাধারণকে এই সংকট মোকাবিলায় সম্পৃক্ত করতে পারি তবে সুপেয় পানির সংকট সমাধান হবে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের মানদণ্ডে নিজেদের সফলতার স্বাক্ষর রাখতে আরেকধাপ এগিয়ে যাবে।

কেননা দিন শেষে জলই জনপদের জীবন, সুপেয় জল যেখানে নেই সেখানে জীবনধারণও উদ্বেগের। সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেই উদ্বেগ কেটে যাক এবারের বিশ্ব পানি দিবসে এই হোক আমাদের কামনা।

লেখক: ড. মুহাম্মদ বদরুল হাসান, সহকারী অধ্যাপক,

                রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ