আমরা জেনে শুনে সুইসাইড করছি
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০৪:২৯ PM , আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:৩৫ PM
বাংলার মোগল সুবাহদার ইসলাম খাঁ ১৭ শতকের শুরুতে ঢাকাকে প্রথম বাংলার রাজধানী করেন। প্রায় চারশত বছরের পুরনো এই ঢাকা শহরে দিনদিন আমাদের জীবন হয়ে পড়ছে বিকল ও বিপর্যস্ত।
১২৫ বর্গমাইল বা ৩২৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ঢাকা সিটির প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৫,০০০ হাজার মানুষের বাস। সেহিসাবে ঢাকা সিটির মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ১ কোটি ৪৬ লক্ষ ২৫ হাজার। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ঢাকা নগরীর জনসংখ্যা এক কোটি ৩০ লাখ। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্টের তথ্য অনুযায়ী ঢাকার জনসংখ্যা বর্তমানে এক কোটি ৭০ লাখ, যা ২০৩০ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে দুই কোটি ৭৪ লাখে।
ঢাকা সিটিতে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে ২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে সাড়ে ৩ কোটি হবে।এমন তথ্যও উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে।যাইহোক ঢাকা এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ঘনবসতিপূর্ণ শহরের একটি। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহর নানা প্রকারের অনিয়ম ও ব্যবস্থাপনায় নাগরিক জীবনের যাপিত দিনগুলো করুণ দশায় আপতিত।বর্তমানে মানব সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ে এই শহর ভারাক্রান্ত। এই শহরের মানুষগুলো জেনেশুনেই স্লো সুইসাইডের সম্মুখীন ।রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গানের দুটো চরণ যেন মিলে যায় ঢাকার নাগরিকদের জীবনের সঙ্গে।
জেনে শুনে বিষ করেছি পান। আমি- জেনে শুনে বিষ করেছি পান, প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালের ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হলো বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন।
হ্যাঁ আজ আমাদের সৃষ্ট বায়ু দূষণে আমরা নিজেরা অকাল প্রয়াত হচ্ছি।প্রতিনিয়ত দূষিত বায়ু সেবনে হচ্ছি নাকাল ও বিপর্যস্ত। এনিয়ে কারো যেন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। জীবন প্রদীপ নিভে গেলেই মরণ নামের মহাসত্যের সাক্ষাৎ ঘটে। সেই চিরন্তণ সত্যকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করার ফুরসত কারো নেই। মরণ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা মানে সত্যকে এড়িয়ে নিজের জীবনে দীঘায়ু ডেকে আনার অবান্তর কল্পনা করা। এজীবন অবিনশ্বর নয়। আকস্মিকভভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন আর তিলে তিলে জীবনকে বিপন্ন করা তো আলাদা বিষয়। আজ আমাদের সৃষ্ট দুর্যোগের কবলে আমরা নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছি মনের অজান্তে, মৃত্যুর কোলে। যে মৃত্যু ভয়ে এতো ছুটোছুটি সেই মৃত্যুকেই আমরা নির্বিঘ্নে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। ঢাকার দূষিত বাতাসে আমাদের জীবন মরণাপন্ন। অথচ এসবে আমরা বড্ড বেখায়াল,গায়ে মাখছি না। ডেঙ্গুসহ যেকোনো প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট দুর্যোগে আমরা হই হতবিহবল, বাঁচার জন্য জানাই আকুতি মিনতি, অথচ মানব সৃষ্ট দূষিত বায়ু সলো পয়জনিংয়ের মতো আমাদের জীবনকে তিলে তিলে নিঃস্ব করে দিচ্ছে, আয়ু করছে সংকুচিত। এ ব্যাপারে আমাদের নেই কোনো দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা! আমরা পারিও বটে। বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য খুবই ভয়াবহ উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। সম্প্রতি দেশের বাতাসে ক্ষতিকর এই উপাদানের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ঢাকার বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের মধ্যে এক থেকে দশে উঠানামা করছে। বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ ধূলিকণা। ঢাকায় বায়ুদূষণের প্রধান উৎসসমূহ হচ্ছে গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া, বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদনকারী যন্ত্র থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া, শিল্পকারখানা এবং কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া। অপরিকল্পিত গৃহনির্মাণ কাজ এবং বিভিন্ন সেবামূলক কাজের জন্য যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি এই বায়ু দূষণের জন্য প্রধানত দায়ী।বায়ুদূষণের এসব উৎস থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া, বাষ্প, গ্যাস ও ধুলিকণা উৎপন্ন হয়, যা কুয়াশা ও ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে।
বায়ু দূষণের ফলে শুধুমাত্র ফুসফুসকেন্দ্রিক রোগ বিস্তার লাভ করতে পারে এমনটি নয়। এর মাধ্যমে স্ট্রোক,হৃদরোগ,ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশের মতো মারাত্মক রোগও ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি অনেক ছোটখাট রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে যেমন- প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে মানসিক অবসাদগ্রস্ততা, শিশুদের মধ্যে অ্যাজমার মতো রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক পুরনো মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ধোঁয়া মানুষের শরীরের ক্ষতি করে। বহু রোগ-ব্যাধি ছড়ায়। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, যক্ষ্মা, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস রোগ এবং ক্ষতিকারক কেমিক্যালের ধোঁয়ার কারণে কিডনির ক্ষতি সাধিত হয়। বাংলাদেশে পরিবেশগত বিশ্লেষণ-২০১৮ শিরোনামের বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণজনিত রোগে প্রতিবছর ৮০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ ফোরামের দাবি ঢাকার ৯০ শতাংশ বাসিন্দা এখন বায়ু দূষণের শিকার। এ ছাড়া ৪০ শতাংশ বাসিন্দা শ্বাসনালীর রোগে আক্রান্ত। প্রতিনিয়ত এই দূষণ বেড়ে চলেছে। এতে গণমানুষের ভোগান্তি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছেন।
হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ।বাংলাদেশ অ্যাজমা এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ, যেখানে প্রতি বছর নতুন করে যোগ হচ্ছে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ।
ঢাকার রাস্তার ধুলায় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মাটিতে যে মাত্রায় ক্যাডমিয়াম থাকার কথা, ধুলায় তার চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। আর নিকেল ও সিসার মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, তীব্র যানজট, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান ও শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ভারী ধাতু ধুলার সঙ্গে যোগ হচ্ছে। ঘরের বাইরে তো বটেই, বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ ও খেলার মাঠেও ভর করছে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে নগরবাসী, বিশেষ করে শিশুরা। শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যানসারসহ রোগবালাই।
নগরবাসীর ওপর ধুলার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বাতাসে অতিমাত্রায় ধুলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শহরের গাছগাছালি। গাছের পাতায় জমছে ধূলার আস্তরণ। ফলে গাছের খাদ্য ও অক্সিজেন তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শুধু তাই নয়, পাতার পত্ররন্ধ্র ও সূর্যের আলোর মাঝখানে ধূলিকণার আস্তর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। ফলে কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্রহণ করতেও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে গাছ।বায়ু দূষণ কমাতে ঢাকা ও এর আশপাশের চার জেলা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জের সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা প্রয়োজন।প্রয়োজন সরকারের শুভ ও তাৎক্ষণিক দৃষ্টি।আজ ভয়াবহ বায়ু দূষণের এ ক্ষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী, দাও সেই তপোবন, নিজেদের সৃষ্ট বায়ুদূষণে এভাবে নিজের জীবন বিলিয়ে দেওয়া তো স্বাভাবিক মরণ হতে পারে না। এটি স্পষ্টত সুইসাইড।