নাহিদের পুরস্কারটি দারিদ্র জয়ের!

এসএম নাদিম মাহমুদ
এসএম নাদিম মাহমুদ  © টিডিসি ফটো

ষোল বছর আগের কথা। আমরা যখন তিন ভাইবোন একই স্কুলে পড়তাম, তখন আমার দরিদ্র কৃষক বাবা আর গৃহিনী মার পক্ষে সবকিছু সামলে উঠা দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। স্কুলে পরীক্ষার ফিস দেয়ার মত টাকা ছিল না। অনেক সময় স্কুলের শিক্ষকরা নামে মাত্র ফিস নিতেন। এইভাবে আমরা পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা দুই ভাই বাবার কৃষি কাজে সহায়তা করতাম। এইগুলো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

আমি স্কুলের ক্লাসে যখন ফাস্ট হতাম, তখন আমার ছোট ভাই নাহিদ তখনো পড়াশুনা মনোযোগী ছিল না। ঘরে আমি হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ি, উঠানে এক পাশে প্রদ্বীপ জ্বেলে আমার ছোট ভাই আর বোন পড়তো।

আমি যখন এসএসসি দেব, তখন আমার ছোট ভাই অষ্টম শ্রেণিতে। ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষায় সে দ্বিতীয় হল। এভাবে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সে দ্বিতীয় হল। এসএসসিতে আমি যে ফলাফল করেছি, দুই বছর পর ও সেই একই জিপিএ পেল। হঠাৎ করে ছোট ভাইয়ের এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সত্যি আমাকে অন্যরকম আনন্দ দিয়েছিল।

আমাদের সংগ্রামটা শুরু হল, ২০০৭ সালের দিকে। একদিকে আমি এইচএসসি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি আর অন্যদিকে আমার ছোট ভাই স্থানীয় একটি কলেজে ভর্তি হয়েছে। বাবা-মার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল আমাদের পড়াশুনার খরচ যোগাযোগেতে। জমি, গরু, গাছ বিক্রি আর কিছু ঋণ দিয়ে সেই সময়গুলো আমরা লড়াই করেছিলাম। যে দিনগুলো আমাদের জীবনে সবচে বেদনাময় দিনগুলো ছিল।

যুদ্ধের এই ময়দানে পেরিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন আমার ছোট ভাই এইচএসসি দিল। এসএসসিতে যেহেতু বড় ভাইয়ের রেজাল্টটাই সেও করেছে, তাই ওর মনের সুপ্ত আসা ছিল সেও তার বড় ভাইয়ের মত এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাবে। কিন্তু ফলাফলে সে পেল ৪.৮০। এটাই বা কম কিসের? ও খুব মন খারাপ করেছিল, কিন্তু আমি তাকে শুধু এইটুকু বলেছিলাম, জিপিএ ৫ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না কেউ সো তোর এই রেজাল্টই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যথেষ্ট।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেও আমি ভর্তি হইনি কেবলমাত্র আমার এই ছোট দুই ভাইবোনের কথা ভেবে। আমি ভর্তি হলে, হয়তো এই দুই জনের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যেত।

২০০৯ সালে ওকে রাজশাহীতে নিয়ে আসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য। সিঙ্গেলরুমে মেসে আমরা একবেডে দুইভাই ঘুমাতাম। এই সময়গুলোতে ওকে নিজের রুমে নিজেই ভর্তির প্রিপারেশন করাইছি। কোন ভর্তি কোচিং ভর্তি করানোর কোন অর্থ আমাদের সেই সময় ছিল না। টিউশনের টাকা দিয়ে দুই ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ বের করতাম। একই শার্ট, লুঙ্গি দিয়ে চলতো আমাদের।

এইভাবে ভর্তি পরীক্ষায় সে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলে চান্স পেল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অপেক্ষমাণ থাকায় সেই সময় তাকে বাড়ির গাছ, জমি বিক্রি করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করালাম। ঢাকায় ওকে যখন একটি মেসে রাখা হল, ও মাস খানেক ক্লাস করে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছিল। ঢাকা ওর কিছুতেই ভাল লাগে না।

আল্লাহ্ অশেষ রহমতে মাস তিনেক পর নাহিদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে জনসংখ্যা বিজ্ঞানে ভর্তির সুযোগ পেল। জগন্নাথের ভর্তি বাতিল করে ওকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসলাম। শুরু হল আমাদের দুই ভাইয়ের একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার গল্প। ছোট বোনকে ভর্তি করালাম রাজশাহীর মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগে। ছোট ভাই-বোনকে নিয়ে আমাদের সংগ্রামময় দিন। টিউশনি, কোচিং করিয়ে চললো আমাদের সংসার।

এইভাবে আমাদের সুখের দিনে ছন্দ পতন ঘটিয়ে আমি ২০১৪ অক্টোবরে চলে আসলাম জাপানে। বছর দুইয়েক আগে ছোট ভাই মাস্টার্স শেষ করলো। টিউশনি করে নিজের খরচ চালিয়েছে। এরপর থেকে চাকরির পরীক্ষায় বসলো সে। বছর খানেক পরীক্ষা দিয়ে অনেকটাই সে হতাশ, পরীক্ষা ভাল দেয় কিন্তু টেকে না। বাবা-মা আমাকে অনেকবার অনুরোধ করেছে, আমার কোন পরিচিত কেউ থাকলে ওর জন্য সুপারিশ করতে।

কিন্তু আমি তা বারবার প্রত্যাখ্যান করেছি। আমি শুধু এইটুকু বলেছি, জীবনে আমরা কখনো কোনদিন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়নি এক্ষেত্রেও না। মনের ভিতর আমাদের এই বিশ্বাসটুকু ছিল, আমরা সৎ পথে চলছি, মহান আল্লাহ্ আমাদের সাহায্য করবেনই। আমার বাবা-মাকে সব সময় বলে এসেছি, ও আমার ভাই, ওই অবশ্যই ভাল কিছু করবে। ছোট ভাইকে শুধু এইটুকু বলতাম, পরিশ্রম করতেছিস ভাল কিছু একদিন পাবি। কারও অনুগ্রহ নিয়ে চাকরি পেলে সারাজীবন নিজের কাছে ছোট লাগবে। এরচেয়ে মেধা দিয়ে কিছু অর্জন করলে তার প্রাপ্তি অবশ্যই মধুর হবে।

গত এক বছর ধরে নাহিদ বেশ কয়েকটি পরীক্ষায় টিকছে। ভাইভার পর আর কোন চাকরির খবর আসেনি। রাজশাহী ছেড়ে ঢাকায় চাকরির প্রস্তুতির জন্য বেশ কয়েকবার তাগাদা দিয়েছি, কিন্তু কাজ হয়নি। ঢাকায় থাকতে ওর অনীহা। তাই রাজশাহী থেকে সে ব্যাংকের জবের প্রস্তুতি নিয়েছে।

ঘন্টাখানেক আগে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সুখবরটি সে দিল। সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে নাহিদ নির্বাচিত হয়েছে। খবরটি শোনেই চোখের কোনে অশ্রু জমছে। এই পুরস্কারটি ছিল তার দারিদ্র জয়ের।

আলহামদুল্লিলাহ্। আল্লাহ্ কাছে শুকরিয়া।

আমাদের দারিদ্রতা আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা। সৎ থাকার লড়াই আমাদের সাফল্যের চাবিকাঠি। পরিশ্রম আমাদের শক্তি। কথাগুলো হয়তো লেখার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু নিজের ছোট ভাই আমার জেরোক্স। ও আমার চেয়ে পড়াশুনায় যেমন ভাল ছিল, ঠিক তেমনি আমার চেয়ে অনেক ভাল লিখতে পারে। আমাদের এই সংগ্রামের যোগ্য সৈনিক নাহিদ। সে আমার চেয়ে তুখোড় মেধাবী।

গত বছর যখন দেশে গিয়েছিলাম, তখন আমরা সবাই গিয়েছিলাম আমাদের বদলগাছীর পাহাড়পুরে। আর ছবিটি ছিল আমাদের তিন ভাইবোনের।

আমার বিশ্বাস, যে সততা নিয়ে আমাদের বেড়ে উঠা, যে সংগ্রাম করে ঠিকে থাকা, সেই পথে ভবিষ্যতের দিনগুলো সে পার করবে। দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ হিসেবে নাহিদ সামনের দিনগুলো মেধা আর পরিশ্রম দিয়ে জয় করবে এই প্রত্যাশা করি। সবার কাছে ওর জন্য দোয়া চাই, আশীর্বাদ চাই।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান


সর্বশেষ সংবাদ