মাইলস্টোনে দুর্ঘটনা নাকি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড, দায় কার?

শরিফুল হাসান
শরিফুল হাসান   © টিডিসি সম্পাদিত

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনা কী কেবলই দুর্ঘটনা নাকি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড? আমি আসলে বাংলাদেশের অধিকাংশ দুর্ঘটনাকে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলি। বিস্তারিত লেখার আগে জানাই, আগুনে দগ্ধ আরও এক শিশু মুসাব্বির মারা গেছে। মুসাব্বিরের শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। এ ঘটনায় সরকারি হিসেবে এখন পর্যন্ত ৩৩ জন মারা গেল। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে ৫১ জন। 

এই ঘটনাকে কী কেবলই দুর্ঘটনা বলা যাবে নাকি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড? দেখেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) কী বলে? আজকে তারা ‘মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনা: জননিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের দায় ও করণীয়’ শীর্ষক এক তাৎক্ষণিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলন করেছে। সংবাদ সম্মেলনে বিআইপির সভাপতি পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান মাইলস্টোনের নিচু এলাকা ভরাটে রাজউক কেন বাধা দেয়নি, সেই প্রশ্ন রেখে বলেন, রাজউক ও বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) কেউ নিজেদের দায়িত্ব পালন করেনি। যারা ভবন তৈরি করেছেন, তারা নিজেরাও অঙ্গীকার ঠিক রাখেননি।

জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান উড়ানোর সুযোগ নেই উল্লেখ করে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা থেকে বিমানবন্দর দূরে ছিল। ঢাকাকে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ বলে যে একটা জিনিস আছে, তা ভুলে যাওয়া হয়েছে। নয়তো বিমানবন্দরের উড্ডয়ন-অবতরণের পাশে স্কুলকলেজের মতো অবকাঠামো হওয়ারই কথা নয়। মৌলিক ব্যাকরণ ভুলে যাওয়া হয়েছে।

বিইপি বলেছে, মাইলস্টোন স্কুল কারিগরিভাবে বৈধ হলেও এটি অনিরাপদ এলাকায় অবস্থিত। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোচ এরিয়ার (বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ অঞ্চল) মধ্যে পড়েছে। বিমানবন্দরের অ্যাপ্রোচ এরিয়ায় থাকা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ জনসমাগম হয়, এমন সব প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়া উচিত।

আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, কয়েক দশক ধরে রাষ্ট্রে যে চর্চা হয়েছিল, তাতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ভূমি ও ভবন নিয়ে। মাইলস্টোনের কয়েকটি ভবনের অনুমোদন আছে, কয়েকটির নেই। যে ভবনে বিমান আঘাত করেছে, সম্ভবত সেটির অনুমোদন নেই। যিনি মাইলস্টোন নির্মাণ করেছেন, তার দায় আছে। এ ছাড়া বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অনুমতি ও অনাপত্তিপত্র নেওয়ার বিষয় আছে। যারা অনুমতি ও অনাপত্তিপত্র দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের দায়ভার আছে। দায়ভার আছে, এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনলে হয়তো ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়ানো যাবে।

সংকটটা এখানেই। এই রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ তদারকি কোন প্রতিষ্ঠানের কাউকে কখনো শাস্তির আওতায় আনতে পারেনি বাংলাদেশ। আপনাদের কী মনে আছে, বেইলি রোডে আগুন লেগে ৪৬ জন মারা যাওয়ার পর রাজউক বলেছিল, তারা ঢাকার প্রতিটি ভবনের নকশা ও অনুমোদন খতিয়ে দেখবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কোথায় সেই তদারকি?

এর আগে বনানীর ভবন থেকে শুরু করে প্রতিটি আগুনের ঘটনার পর কথা ছিল এই শহরের প্রতিটি ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা দেখা হবে। কেন হয়নি? এর দায় কার?  অনেকবার  লিখেছি, এই দেশে ভবনে কোন দুর্ঘটনা বা আগুন লাগার পর জানা যায় অনুমোদন নেই। বাস বা লঞ্চের যে কোন দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর পর জানা যায় ফিটনেস নেই। সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে সন্তানের মৃত্যুর পর জানা যায় হাসপাতালের অনুমোদন নেই। তার আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কারো ঘুম ভাঙে না। এ কারণেই আমি বলি এগুলো কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড!

রাজউক বলেন, বিআরটিএ বলেন, ওয়াসা বলেন, তিতাস বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেন কতো যে সরকারি সংস্থা আর মন্ত্রনালয় আছে! কিন্তু প্রত্যেকটা সরকারি সেবা সংস্থার সবাই যেন ঘুমায়! সেখানে গড়ে ওঠে দুর্নীতির পাহাড়। আচ্ছা, ঘুষ না দিয়ে রাজউক থেকে এই শহরে কয়জন মানুষ ভবন নির্মাণের অনুমোদন পেয়েছেন? শুধু এই জরিপটা চলুক তাহলেই বোঝা যাবে তাদের মান! প্রতিটা সরকারি সেবা দপ্তরের যেন একই অবস্থা!

এসব কারণেই আমি এগুলোকে আর এখন দুর্ঘটনা বলি না। এগুলো হত্যাকাণ্ড! এগুলো সিস্টেমটিক হত্যাকাণ্ড! আপনি খেতে গিয়ে মরবেন, হাসপাতালে সুন্নতের খতনা করতে গিয়ে মরবে আপনার সন্তান, এন্ডোসকপি করতে গিয়ে মরবে আপনার ভাই, নির্মাণাধীন ভবনের রড পড়ে মারা যাবে কোনো বাবা, বাস দুর্ঘটনা, ট্রেনে আগুন কিংবা ভবনের আগুনে মারা যাবে সাধারণ মানুষ, গার্মেন্টস বা কারখানায় মরবে শ্রমিক আর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা স্কুলে পুড়ে মরতে হবে নিষ্পাপ শিশুদের।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন সাধারণ মানুষের দোষ। তারা সচেতন নয়। অবশ্যই কথা সত্য। কিন্তু সাধারণ মানুষকে আইনের আওতায় আনার দায়িত্ব কার? যারা আইন ভাঙে তাদের বিরুদ্ধে কেন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না? আমি মনে করি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে সবাই নিয়ম মানতে বাধ্য।

আফসোস, প্রতিবারই মৃত্যুর ঘটনার পর নতুন করে তদন্ত কমিটি হয়, নানা আলোচনা হয়, তারপর আমরা ফের অপেক্ষা করি নতুন কোন দুর্ঘটনার! আচ্ছা, স্বাধীনতার তো ৫৪ বছর হলো! এভাবে আর কতদিন চলবে? আর কতো মানুষ মরলে আমাদের হুঁশ হবে? আর কতো মানুষ মরলে এই রাষ্ট্রের ঘুম ভাঙবে? আর কবে আমরা বুঝব উন্নয়ন মানে শুধু বড় বড় ভবন নয়, জবাবদিহিতা ও সুশাসন জরুরি।

আমার  প্রতিটা কথা পুরোনো। গত ২০ বছরে অনেকবার এই কথাগুলো লিখেছি। আমি বিশ্বাস করি নীতি নির্ধারকেরা চাইলে, সবাই মিলে চাইলে এই দেশের প্রত্যেকটা সমস্যার সমাধান সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন সুশাসন ও জবাবদিহিতা। কাজেই আপনারা যারা দেশ চালান, যারা প্রশাসন চালান, আপনারা যারা ক্ষমতাবান, আপনারা যারা নীতি নির্ধারক, আপনাদের কাছে হাতজোড় করে বলি, জেগে উঠুন নয়তো দেখবেন একদিন আপনার আমার সন্তান বা আমরা কেউ বেঁচে নেই। কাজেই দোহাই লাগে ফের এমন প্রাণহানির আগে ব্যবস্থা নিন। 

শরিফুল হাসান: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence