‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ কী, প্রধান উপদেষ্টা কি স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে যাচ্ছেন?
- রাজু নূরুল
- প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:১২ PM , আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫, ১২:৩১ PM
কিছুদিন আগে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তার বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্সের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। ক্ষমা চেয়ে তিনি বলেছেন, ‘সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় বাবার ঠিকাদারি ব্যবসায় জড়ানো স্পষ্টভাবেই কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট। বিষয়টি বোঝানোর পর বাবার আবেদনের প্রেক্ষিতে লাইসেন্সটি বাতিল করা হয়েছে।’ এ ঘটনার পর সচেতন মহলে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ কথাটি আলোচনা হচ্ছে জোরেসোরে।
‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ কী, কেন এটা অন্যায় তা আলোচনা করার আগে একটা ছোট গল্প বলি। আমার একবন্ধু সোনালী ব্যাংকে চাকুরি করে। বন্ধুর কাছে শোনা গল্প! আপনাদেরকেও শেয়ার করি।
বন্ধুর ম্যানেজার একটু খাটাশ প্রকৃতির। ব্যাংকে দুপুরে যে কর্মচারীদের জন্য রান্না হয়, সেই সাপ্তাহিক বাজার তিনি নিজে করেন। মুরগি কিনলে সেই মুরগির গিলা-কলিজা পলিথিনে ভরে বাসায় নিয়ে যান। এরপর জনপ্রতি মিলের হিসাবও তিনি নিজেই করেন। এটা নিয়ে ব্যাংকের লোকজন হাসাহাসি করেন। শোনার পর আমরাও খুব হাসলাম!
হাসির বাইরেও এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে। কী সেটা, আসুন জানি। একই ব্যক্তি ব্যাংকের ক্ষমতাশালী ম্যানেজারের পদে থেকে সাপ্তাহিক বাজার করা, জনপ্রতি মিল চার্জ কত পড়বে সেই হিসাব করা এবং দিনশেষে মুরগির গিলাকলিজা পলিথিনে ভরে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন না। এতে করে ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
ধরেন, আপনি একটা স্কুলে পড়েন—আপনার ইংরেজি শিক্ষক হচ্ছেন আপনার ছোট মামা! পরীক্ষার দিন আপনি ঠিকমতো লিখতেই পারেননি, কিন্তু ফাইনালের রেজাল্ট দেখলেন আপনি ‘এ প্লাস’ পেয়েছেন। মামা যে শিক্ষক হিসেবে নিরপেক্ষ থাকার কথা, তা তিনি থাকতে পারেননি, আত্মীয় বলে আপনাকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছেন—এটাই হলো স্বার্থের সংঘাত!
আরও একটা উদাহরণ দেয়া যাক। একজন ট্র্যাফিক পুলিশ নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে স্পিড লিমিট ভেঙে ফেললেন। নিয়ম অনুযায়ী জরিমানা হওয়া উচিত। কিন্তু তিনি নিজেই ফাইন কেটে, পরে নিজের নামে জরিমানা মাফ করে দিলেন! তার মানে পুলিশ হিসেবে আইন মেনে কাজ করার কথা থাকলেও, নিজের লাভের জন্য তিনি নিয়ম ভেঙেছেন। আপনি অফিসের ইন্টারভিউ বোর্ডে থেকে সেই অফিসে আপনার পরিবারের কাউকে চাকুরি দিলে সেটাও স্বার্থের সংঘাত হবে।
তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে, যখন কেউ নিজের ব্যক্তিগত লাভ (অর্থ, পরিবার, বন্ধু, নিজের ব্যবসা ইত্যাদি) ও তার পেশাগত দায়িত্ব (চাকরি, সিদ্ধান্ত, নিয়োগ, বিচার ইত্যাদি)—এই দুইটির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হয়, তখন স্বার্থের সংঘাত তৈরি হয়! আরও স্পষ্ট করে বললে, ‘আপনার দায়িত্ব আর আপনার ব্যক্তিগত লাভ একই সময়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলে’ — সেটা স্বার্থের সংঘাত। এটা খুব বিপজ্জনক, কারণ এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যায়।
প্রশ্ন হলো, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কি স্বার্থের সংঘাতে জড়িয়ে যাচ্ছেন? কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক।
১. প্রধান উপদেষ্টা হওয়ামাত্র দেড় মাসের মাথায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আদালতের দেয়া ৬৬৬ কোটি টাকা কর পরিশোধের রায় তিনি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এ প্রত্যাহার করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শুনানি ও আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি, যেটি সম্পূর্ণভাবে স্বার্থের সংঘাত। এখানে কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সুরাহা করা যেত।
২. ড. ইউনূস ক্ষমতায় বসার পর এখন পর্যন্ত একমাত্র অনুমোদন দেওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলো, গ্রামীণ ইউনিভার্সিটি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য হিসেবে আছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ছোটো ভাই মুহাম্মদ ইব্রাহিম এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী লামিয়া মোর্শেদ। লামিয়া মোর্শেদ আবার ইউনূস সেন্টারেরও পরিচালক।
৩. পিএসপি লাইসেন্স পেয়েছে গ্রামীণ টেলিকমের প্রতিষ্ঠান। যেখানে রবি, বাংলালিংকের মতো একাধিক প্রতিষ্ঠানের পিএসপি লাইসেন্স পাওয়ার আবেদন দীর্ঘদিন ফাইলবন্দি হয়ে আছে।
৪. গ্রামীণ এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিস নামে জনশক্তি রপ্তানির লাইসেন্স পেয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠান।
৫. গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালক নূরজাহান বেগমকে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা করা হয়েছে। তার বয়স, অভিজ্ঞতার বিচারে এই পদ পাওয়ার যোগ্য কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
৬. ইউনুস সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক লামিয়া মোর্শেদকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় এসডিজি বিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন ড. ইউনূস। এটাও স্বার্থের সংঘাতের আওতায় পড়ে।
৭. নিজের আপন ভাই মরহুম মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের ছেলে অপূর্ব জাহাঙ্গীরকে উপপ্রেস সচিব পদে নিয়োগ দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর আগে অপূর্বর এ সংক্রান্ত কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। তিনি এখনো এই পদে বহাল আছেন।
৮. গ্রামীণ ব্যাংককে ব্যক্তিমালিকানা থেকে সরিয়ে সরকারের কাছে জবাবদিহির একটা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু আবারও সরকারের মালিকানা ২৫% থেকে কমে ১০%- এ নিয়ে আসা হয়েছে। গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত ব্রিফ করতে গিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলছিলেন, ‘আমরাতো চাই সরকারের মালিকানা শূন্যতে নেমে আসুক। কিন্তু উনি রাজি হননি।’
৯. বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী ইউনূস সেন্টারের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য।
১০. গত বছরের অক্টোবরে গ্রামীণ ব্যাংকের যাবতীয় আয়ের কর অব্যাহতি দেয় সরকার। আয়কর আইন, ২০২৩ এর আওতায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারি করে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৯ তারিখ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃক অর্জিত সব আয়কে শর্তসাপেক্ষে কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে। এর ফলে হাজার কোটি টাকার বেশি কর মওকুফ পাবে গ্রামীণ ব্যাংক।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, স্বার্থের সংঘাত কেনো গুরুত্বপূর্ণ? এর পেছনে কয়েকটা কারণ আছে। যেমন, স্বার্থের সংঘাত হলে সিদ্ধান্ত ঠিকঠাক হয় না। যোগ্যদের প্রতি অবিচার করা হয়। ন্যায়বিচার ও সিস্টেম ভেঙে পড়ে। সর্বোপরি সমাজে আস্থার সংকট দেখা দেয়।
প্রশ্ন আসতে পারে, এসব নিয়োগে ড. ইউনূস কি আইন ভঙ্গ করছেন? বা বিশেষ করে ‘স্বার্থের সংঘাত’ (Conflict of Interest) নিয়ে সরকারের কোনো নির্দিষ্ট আইন আছে কিনা। সরাসরি উত্তর হলো, না, বাংলাদেশে শুধুমাত্র সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো আলাদা আইন নেই। তবে নিয়ন্ত্রক নীতিমালা এবং অন্যান্য আইনে এ বিষয়টি পরোক্ষভাবে উল্লেখ আছে। যেমন: সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ (Government Service Act, 2018), যেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নৈতিকতা, আচরণ এবং পদোন্নতি/নিয়োগে স্বচ্ছতা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রভাবিত হয়ে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতে পারে। তবে এখানে ‘স্বার্থের সংঘাত’ শব্দটি সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।
সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯ (Government Servants (Conduct) Rules, 1979) তে এই সংক্রান্ত তথ্য আছে। সরকারি কর্মচারীদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সরকারি দায়িত্বের সংঘাত থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা রয়েছে। যদি কোনো কর্মকর্তা নিজে বা তার পরিবারের সদস্য নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরাসরি লাভবান হন, তা আইন লঙ্ঘন হবে। নিয়োগ বোর্ডের সদস্য হলে আত্মীয় বা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে নিজেকে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে বিরত রাখতে হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ (Anti-Corruption Commission Act, 2004)- এ সরকারি নিয়োগে দুর্নীতি, পক্ষপাতিত্ব বা স্বার্থের সংঘাত ঘটলে তদন্ত ও শাস্তির বিধান আছে। ফলে সরকারি ক্রয় নীতিমালা ও টেন্ডার নীতিমালার মতোই (যেমন শিশু উপদেষ্টা আসিফের বাবার ঠিকাদারি লাইসেন্স), নিয়োগেও অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বার্থের সংঘাত এড়ানোর চেষ্টা করা হয়, যদিও নির্দিষ্ট করে নিয়োগের জন্য আলাদা Conflict of Interest law নেই।
সারা দুনিয়াতেই ক্ষমতায় থাকা লোকজন এ বিষয়ে সাবধান থাকেন। কেননা, ক্ষমতা হারালেই এসব দ্বন্দ্ব মাথার ওপর খড়্গ হয়ে নেমে আসার উদাহরণ অনেক। যেমন, হিলারি ক্লিনটন যখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন (২০০৯–২০১৩), সেই সময়ে ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশন’ নামে একটি দাতব্য সংস্থার জন্য সারা দুনিয়া থেকে বড় বড় অনুদান আসছিল। ড. ইউনূসও ছিলেন দাতাদের একজন। অভিযোগ ওঠে যে, যারা ফাউন্ডেশনে অনুদান দিচ্ছিল, তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সুবিধাও পাচ্ছিল। এখানে স্বার্থের সংঘাতটা ছিল এরকম যে, সরকারি পদে থেকে ব্যক্তিগত সংস্থার জন্য সুবিধা নেয়া বড় ধরনের স্বার্থের অপরাধ। ফলে হিলারি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন, এ নিয়ে তখন তদন্ত হয়, যদিও সরাসরি অপরাধ প্রমাণ হয়নি। কিন্তু হিলারির ভাবমূর্তির বড় ক্ষতি হয়েছিল, যার বিশেষ প্রভাব পড়েছিল ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।
আমেরিকার ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিও আরেকটা উদাহরণ হতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের লোকজন বিরোধীদলের অফিস থেকে গোপনে তথ্য চুরি করেছিল। পরে যখন তদন্ত শুরু হয়, তখন নিক্সন নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে তদন্ত ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলেন। এর ফল ছিল মারাত্মক। ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু হয়। নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
লেখক: লেখক, অনুবাদক ও গবেষক
যোগাযোগ: raju_norul@yahoo.com