ভোটের মাঠের জামায়াত: কিছু ঐতিহাসিক ভুল
- সাইদুর রহমান
- প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৩৯ PM , আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৩:৩৬ PM
মাঠের রাজনীতিতে যতটা গর্জন দেখা যায় নির্বাচনী রাজনীতিতে ঠিক উল্টো অবস্থান জামায়াতে ইসলামীর। নির্বাচনী রাজনীতির সমীকরণে হোঁচট খাওয়া দলটির ইতিবৃত্ত তুলে ধরবার চেষ্টা করেছি।
স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি নির্বাচনে দলটি অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়নি। ২টি নির্বাচন জামায়াত বর্জন করেছিল। একটি এরশাদের ১৯৮৮ সালের ৩রা মার্চ আরেকটি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। একটি নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে অংশ নিয়েছিলো। আরেকটি নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে অংশগ্রহণ করে। দলটির নিজস্ব প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ৫টি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে।
দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে জামায়াতের অংশগ্রহণ করা ৫টি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিগত ৫টি নির্বাচনে দলটি গড়ে ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। ৫টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ পর্যন্ত ৫০টি আসন পেয়েছে জামায়াত। তাদের গড় আসন মাত্র ১০টি। ভোটের মাঠে গড়ে ১০টি আসন পাওয়ার মতো উপযোগী রাজনৈতিক দল জামায়াত সামনের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরো বেশি সংখ্যক আসন প্রাপ্তির প্রত্যাশা করছে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ থাকার কারণে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, নিবন্ধন বাতিল হওয়ার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে জামায়াত অংশগ্রহণ করতে পারেনি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে জামায়াতের প্রার্থীরা অংশ নিয়েছিলো। কিন্তু বিতর্কিত রাতের ভোটের নির্বাচনে একজন প্রার্থীও জয়লাভ করতে পারেনি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ৬ শতাংশ ভোট পাওয়া জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরে যুদ্ধ শেষে নিষিদ্ধ হয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করলে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পায় জামায়াত। কিন্তু দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ব্যানারে দলটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ১৯৭৯ সালে আই.ডি.এল (ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ)-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর ছয়জন এমপি নির্বাচিত হন।
স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম দাঁড়িপাল্লা প্রতীক প্রদর্শনের সুযোগ আছে স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে। ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জামায়াত ১০টি আসন পেয়েছিলো। সেই নির্বাচনে দলটি ভোট পায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো করে জামায়াত। দলটির বাক্সে পড়ে ১২ দশমিক ১০ শতাংশ ভোট। দলটি আসন পায় ১৮টি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল একক শক্তিতে যে ভোট করে, তাতে জামায়াতের ভোট কমে যায়। ওই নির্বাচনে জামায়াত মোট ভোটের ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ পায়, আসন নেমে আসে ৩টিতে।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে অংশগ্রহণ করে। ওই নির্বাচনে জামায়াতের আসন ১৭টি হলেও তাদের ভোট ছিল ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সাথে জোটবদ্ধভাবে জামায়াতের দাঁড়িপাল্লায় ভোট পড়ে ৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। আসন কমে হয় যায় দুটি।
নির্বাচনী রাজনীতিতে জামায়াতের পিছিয়ে থাকার কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিগত সময়ে কিছু ঐতিহাসিক ভুলের কারণে দলটি জনগনের মন জয় করতে পারেনি। কিছু ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে রাজনীতি করা জামায়াত ভোটারদের কাছে টানতে পারেনি।
জামায়াত ও কিছু ভুল সিদ্ধান্ত : সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী কর্তৃক ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি এ পর্যন্ত তিনবার নিষিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬৪, ১৯৭১ এবং ২০২৪ সালে নিষিদ্ধ হয়। বেশকিছু গৃহীত ভুল সিদ্ধান্ত ইসলামিক এই রাজনৈতিক দলটি গণমানুষের দলে পরিণত হতে দেয়নি। ইতিহাস পর্যালোচনা করে জামায়াতের রাজনীতির বেশকিছু ভুল সিদ্ধান্ত চিহ্নিত করেছি।
১। জামায়াত ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের তৎকালীন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগকে সমর্থন করেনি
২। ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল।
৩। ১৯৬৫-এর নির্বাচনে জামায়াত ইসলাম সর্বপ্রথম নারী নেতৃত্ব ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এতে জামায়াতের সমর্থনে ভাটা পরে এবং এই প্রথম মওদূদীকে ইসলামী আন্দোলনের নেতার পরিবর্তে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখতে শুরু করে।
৪। আওয়ামী লীগ প্রদত্ত ছয় দফা এবং মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষিত ১১ দফার তীব্র বিরোধিতা করে জামায়াত।
৫। ১৯৭১ সালে জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তীব্র বিরোধিতা করে। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে। এরা পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে কাজ করে।
৬। স্বৈরাচার এইচ এম এরশাদের নির্বাচনে বৈধতা দেয়ার জন্য ১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাথে অংশগ্রহণ করেছিলো জামায়াতও। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিলো বিএনপি।
৭। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকার কর্তৃক অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টির সাথে সংঘবদ্ধভাবে নির্বাচন বর্জন করে জামায়াত। তিনটি দল লাগাতার বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আন্দোলন করেছিলো।
৮। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপিকে অংশগ্রহণে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করেছিলো জামায়াত। শেষমেষ জামায়াতের চাপে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিলো বিএনপি-জামায়াত।
৯। গণতান্ত্রিকভাবে জামায়াত ইসলামী রাজনৈতিক দল না হয়েও ইসলামকে রাজনীতিতে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা।
১০। সর্বশেষ ২০২৪ সালে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা পতনের সাথে সাথে প্রকাশ্য বিএনপির বিরোধিতা করে জামায়াতে নেতাকর্মীদের অবস্থান গ্রহণ। তূণ মূলে বিএনপির কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ঢালাও নেতিবাচকভাবে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া আইডি খুলে অপপ্রচার চালানো।
জামায়াতে ইসলামী উপরিউক্ত ভুল সিদ্ধান্তগুলো বা চক্রান্তের বিষয়ে কখনোই দলীয়ভাবে স্বীকার করা হয়নি। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধীতার জন্য নিজেদের অবস্থান জাতির কাছে স্পষ্ট করেনি। গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার বিপ্লবে জামায়াতের অবদান অস্বীকার করবার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই বিপ্লবের ফসল এককভাবে ঘরে তুলবার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত তাতে সবারই ক্ষতি হচ্ছে। ভোটের মাঠে পিছিয়ে যাচ্ছে দলটি।
লেখক: রাজনীতি ও নির্বাচন কমিশন বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক।