বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের গ্রামে যেতে হবে, এটা তাকে মানুষ থেকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করবে
![ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন](https://cdn.thedailycampus.com/resources/img/article/202405/141679_161.jpg)
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। একাধারে একজন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ। দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে। এছাড়া তিনি ছিলেন বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য পদেও। এর আগে ১৯৭৩-৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। দেশে বেসরকারি উচ্চশিক্ষা খাতের অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধির সাথে জড়িয়ে থাকা এই গুণীজনের সাথে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতি, চলমান অসঙ্গতি, পাঠ্যক্রম এবং আগামীদিনের অগ্রযাত্রা নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। তার কথাগুলো শুনেছেন আহমেদ ইউসুফ।
বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গল্প এবং এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে জানতে চাই। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারছে?
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপূরক হিসেবে কাজ করার লক্ষ্য নিয়ে। তাদের সাথে প্রতিযোগিতার জন্য নয়। আমাদের জনসংখ্যা বেশি, পক্ষান্তরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা কম ছিল। সেই অবস্থায় শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাচ্ছিল। ফলে দেশ মেধাশূণ্য হয়ে পড়ছিল।
এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের বহির্বিশ্বে না গিয়ে—দেশে যোগ্য জনসম্পদ তৈরি, ফরেইন এক্সচেঞ্জ রোধকরন, সাংস্কৃতিক অভিঘাত রোধ করা, বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিতকরণসহ বৃহত্তর স্বার্থে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। সেজন্য সাবেক কূটনীতিক মুসলেহ উদ্দিন আহমদ, ড. মাজেদ খান, ডা. নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক এম আলিমুল্লাহ মিয়াসহ যেসকল গুণীজন দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই যাত্রাকে সফল করেছেন আমি তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।
প্রথমত একাডেমিয়া এবং কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডকে একযোগে চলতে হবে। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদলে কো-আপ এডুকেশন সৃষ্টি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সকল শিক্ষার্থীকে শীতকালীন সেমিস্টারে গ্রামে কাটাতে হবে। তাদেরকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মা এবং মাটির সাথে সংযোগ তৈরি করতে হবে; যেটা তাকে বেটার প্ল্যানার হিসেবে গড়ে তুলবে এবং একইসঙ্গে মানুষ থেকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করবে।
দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ এ যাত্রায় বিভিন্ন সময় ঢেউ এসেছে। তবে মৌলিক লক্ষ অটুট রেখে অনেক প্রতিষ্ঠান সুনামের সাথে পাঠদান করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে। অনেক সময় বিভিন্ন জনের অপকর্মের সংবাদ উঠে আসছে, তখন দুঃখিত হই। যদিও আমি মনে করি ব্যতিক্রম কয়েকটি ঘটনা ব্যতীত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যই মহৎ।
বলা হচ্ছে—সাম্প্রতিককালে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রথম সারির সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে ভালো করছে। আসলে তারা কতটা ভালো করছে, কোন কোন সূচকে বেশি ভালো করছে?
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আমাদের দেশে সচরাচর অবিভাবকদের একটি দৃষ্টিকোণ থাকে যে, উচ্চমাধ্যমিক শেষে সন্তানদের বুয়েট, আইবিএ, মেডিকেল কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রতিষ্ঠানে পড়াবেন। বিপরীত চিত্র হলো দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাতালিকায় প্রথম সারির শিক্ষার্থীদের না পেলেও মানসম্পন্ন কারিকুলামের মাধ্যমে যোগ্যতাসম্পন্ন এবং বাজার উপযোগী মানবসম্পদ তৈরির কাজটি সুনিপুণভাবে করে যাচ্ছে। পাশাপাশি বর্তমানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম অনেক বেশি আধুনিক।
তবে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর মতো প্রতিষ্ঠানকে আমি কুর্ণিশ করছি। এছাড়া যেকোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রথম সারির প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এগিয়ে থাকছে। এখানে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক পিএইচডি ডিগ্রিধারী। যেটি শিক্ষার্থীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞান বিতরণে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
বিভিন্ন র্যাংকিং এবং অন্যান্য সূচকেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ভালো করছে। যদিও র্যাংকিংয়ের সূচকগুলো বিভিন্ন ইন্ডিকেটরের উপর নির্ভর করায় বাস্তব চিত্র কিছুটা ব্যতিক্রম। একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো— সম্প্রতি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস এডমিনিস্টেশনের চেয়ার অধ্যাপক ফারহানা ফেরদৌস যুক্তরাষ্ট্রের এসিবিএসপি কর্তৃক এক্সিলেন্স ইন টিচিং অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। সম্ভবত বাংলাদেশে এটিই প্রথম।
আপনি একটি সাক্ষাৎকারে আপনার বাবাকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, তিনি বলতেন— ‘লেখাপড়াই যদি না শিখলা, তাহলে দেশ কীভাবে স্বাধীন করবে, কীভাবে মানুষের মতো মানুষ তৈরি হবে।’ এই যে দেশ স্বাধীন এবং দেশ গড়ার ক্ষেত্রে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা কতটা অবদান রাখতে পারছে?
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আমরা শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি হাতে-কলমে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ দিতে ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার পথ উন্মুক্ত করতে সিলেবাসে এ সংক্রান্ত কোর্স অন্তর্ভুক্ত করেছি। প্রতিটি শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলকভাবে এটি অধ্যয়ন করছে। যেটি দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছি।
দেশের চাকরির বাজারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ‘বিসিএস’ প্রবণতা থাকলেও বেসরকারিতে এটি কম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আসলে কোন কোন সেক্টরে ভালো করছে?
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আমাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের উপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ইস্ট ওয়েস্টের ৭৭ ভাগ শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। আবার এডিবির সমীক্ষা বলছে, বিশেষভাবে সিএসই এবং ইকোনমিক্সের গ্র্যাজুয়েটদের কদরে বুয়েটের পর ইস্ট ওয়েস্টের শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে রয়েছে। এছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ, এমবিএ থেকে পাসকৃত ডিগ্রিধারীরা এখন জব মার্কেটে ভালো করছে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই-ইইই অর্থাৎ বিজ্ঞান-প্রকৌশলে বেশি এবং সামাজিক বিজ্ঞান, রাজনীতি ও সাহিত্যের মত বিষয়ে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কি রাষ্ট্র পরিচালনায় পিছিয়ে থাকে?
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: আধুনিককালে এগিয়ে যেতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অধ্যয়ন এবং ব্যবহার আবশ্যকীয়। তবে রাষ্ট্রের বৃহত্তম স্বার্থকে মাথায় রেখে আমরা সকল প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদের ইন্ট্রোডাকশন টু কম্পিউটার সায়েন্স, এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট এবং হিস্ট্রি অব লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ বিষয়ে অধ্যয়নকে বাধ্যতামূলক করেছি। যেটি শিক্ষার্থীদের যোগ্য মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার মূল ধারায়ও অবদান রাখতে সাহায্য করবে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৭ ভাগ শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। আবার এডিবির সমীক্ষা বলছে, বিশেষভাবে সিএসই এবং ইকোনমিক্সের গ্র্যাজুয়েটদের কদরে বুয়েটের পর ইস্ট ওয়েস্টের শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে রয়েছে।
বর্তমানে দেশের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও উদ্ভাবনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কেমন অবদান রাখছে? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রি চালুর অনুমতির বিষয়টি নিয়ে জানতে চাই।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: গবেষণাকে ত্বরান্বিত করতে ইস্ট ওয়েস্টসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গবেষণা সম্প্রসারণ সেন্টার রয়েছে। আর যেসকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করতে সক্ষম তাদেরকে এ সংক্রান্ত অনুমতি প্রদান করতে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা অসংখ্যবার যোগাযোগ করেছি, অনুরোধ জানিয়েছি। আমরা এটাও বলেছি— যথাযথ কাঠামো প্রদান করে এবং কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদের এমফিল ও পিএইচডি করানোর অনুমতি দেওয়া হোক। তবে এখনও সেই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।
সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের জন্য ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা কতটা পূরণ হয়েছে? আগামী ১০ বছর পর ইস্ট ওয়েস্টকে কোথায় দেখতে চান?
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: অনেক সময় টিউশন ফি কম হলে আমরা মনে করে থাকি শিক্ষার গুণগত মান কম। তাই এক্ষেত্রে আমরা একইসাথে ব্যালেন্স এবং শিক্ষার্থীদের অধিক পরিমাণে শিক্ষাবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সকল স্তরের শিক্ষার্থীরা পড়ছেন। এটির নেপথ্যে রয়েছে শিক্ষার গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখার দৃঢ় প্রচেষ্টা এবং বিশ্বমানের শিক্ষা প্রদান।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের হাতে গড়া ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য—আগামী ৫ বছরে আমরা এশিয়ায় সেরা হতে চাই এবং ১০ বছর পর বৈশ্বিকভাবে খ্যাতনামা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। ইতোমধ্যে আমাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ক্রেডিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে বাইরে যাচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের মানসম্পন্ন কারিকুলাম এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছি।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন দরকার আছে?
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: প্রথমত অ্যাকাডেমিয়া এবং কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডকে একযোগে চলতে হবে। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদলে কো-আপ এডুকেশন সৃষ্টি এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সকল শিক্ষার্থীকে শীতকালীন সেমিস্টারে গ্রামে কাটাতে হবে। তাদেরকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে মা এবং মাটির সাথে সংযোগ তৈরি করতে হবে; যেটা তাকে বেটার প্ল্যানার হিসেবে গড়ে তুলবে এবং একইসঙ্গে মানুষ থেকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করবে।