সুস্থ রাজনীতি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কখনো বাধা হয়নি

ছাত্ররাজনীতি বিমুখ নিয়ে ছাত্র সংগঠনের নেতাদের ভাষ্য

ছাত্রনেতারা
ছাত্রনেতারা  © টিডিসি ফটো

ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ছাত্র-শিক্ষক, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবী মহলে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। সম্প্রতি বুয়েটে নিষিদ্ধ রাজনীতি ফেরানোর দাবিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অনড় অবস্থানের পর থেকে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। বুয়েটের হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষার্থী চায় বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকুক। কিন্তু ছাত্রলীগ চায় বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি চালু করতে। পাশাপাশি অন্যান্য ছাত্র সংগঠনগুলোও নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি চায়।

ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বর্তমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কার্যক্রম চায় না বিরোধীদলের ছাত্র সংগঠনগুলো। তবে ক্যাম্পাসগুলোতে কেমন রাজনৈতিক কার্যক্রম চালু হলে শিক্ষার্থীদের রাজনীতির প্রতি আস্থা ফিরবে, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। এ বিষয়ে প্রশ্ন ছিল বিভিন্ন ক্যাম্পাসের ছাত্রনেতাদের কাছে। তাদের কথাগুলো তুলে ধরছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) শেখ সাদী ভূঁইয়া।

সুস্থ রাজনীতি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কখনো বাধা হয়নি
বাংলাদেশ জন্মের বীজ বপন হয় ছাত্ররাজনীতির মাধ্যমে। এ দেশের বিজয় থেকে শুরু করে গণমানুষের যেকোনো লড়াই-সংগ্রামের সাথে ছাত্ররাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার ইতিহাস এখন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাস করার জন্য বইয়ে পড়লেও প্রকৃতপক্ষে এর প্রয়োজনীয়তা ধারণ করতে পারেনি। যার ফলাফল আমাদের এই রাজনীতি বিমুখ প্রজন্ম।

সব ক্ষেত্রেই ভালো-খারাপ মানুষ রয়েছে, থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এ দেশের রাজনীতিতে আমি মনে করি, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে প্রায় ২০ বছর সুপরিকল্পিতভাবেই খারাপ মানুষদের ও ব্যবসায়ীদের রাজনীতিতে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। ফলে একটা দীর্ঘ সময় ধরে অযোগ্য মানুষ থেকে অযোগ্য মানুষের হাতে রাজনীতি চলে গেছে। ফলে যোগ্যরা রাজনীতির সুযোগ বঞ্চিত হয়েছে।

পরবর্তীতে একটা গোষ্ঠী সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পিতভাবে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বিষোদগার করেছে। ফলে যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি থেকে দিনের পর দিন সরে গেছে। এতে করে অযোগ্যরা জায়গা দখল করে নিয়েছে এবং আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

তাই এখন বর্তমান ছাত্ররাজনীতিতে এতো ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হলেও একটা মেজরিটি অযোগ্য নোংরা অংশের জন্য সেটি আশার আলো দেখছে না। কারণ তাদের সংখ্যাটা বেশি।

এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় মেধাবী ও যোগ্যদের ৭০ পূর্ববর্তী সময়গুলোর মতো রাজনীতিতে আসতে হবে। তাদেরকে এ দেশের কৃষক-শ্রমিকের টাকায় পড়াশোনা করে স্বার্থপরের মতো বিদেশ না পালিয়ে দায়বদ্ধতা থেকে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। তাহলেই কেবল অযোগ্যদের প্রতিরোধ করা সম্ভব।

ইতিহাস বলে, সুস্থ ছাত্ররাজনীতি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কখনো বাধা হয়নি বরং সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। যারা কোনো ইস্যু পেলেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে চাইছেন এবং শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন বিবৃতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের উস্কানি দিচ্ছেন, তারা আগে নিজেদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিবৃতি দিলে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হতো। পরিশেষে বলবো, রাজনীতি নিষিদ্ধ নয় বরং সুস্থ রাজনীতি চালু করা মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত।

মেহেদী হাসান
সহ-সভাপতি 
বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, যবিপ্রবি শাখা।

সরকার ও ছাত্রলীগের কারণে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররাজনীতি এখন কাঠগড়ায়। সংগঠনগুলোর একশ্রেণির নেতাকর্মীর অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতি বিমুখ করছে। বর্তমান বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে আছে একটি বিশেষ মহল, তাদের স্বৈরাচারী মনোভাব দেশের প্রতিটি সেক্টরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। একইভাবে বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিকেও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।

সরকারের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হল দখল, সিট বাণিজ্য, ক্যাম্পাসে মাদক বাণিজ্য, ধর্ষণ করে সেঞ্চুরি উদযাপন করাসহ নানান অপকর্ম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং মেধাবী সচেতন শিক্ষার্থীরা বিভিন্নভাবে অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

এমনকি অনেক শিক্ষার্থীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যা তার চাক্ষুষ প্রমাণ। অনেক সময় ছাত্রলীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে সরকারি বাহিনী দ্বারা অনেকে নির্যাতিত হয়েছে, গুম হয়েছে, খুন হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়ে থানায় রিমান্ডের নামে অমানবিক নির্যাতনের দ্বারা পঙ্গুত্ব বরণ করেছে।

মূলত বর্তমান সরকার ও তার ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের এমন ঘৃণ্য কাজের কারণে ছাত্র সমাজ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়ছে।

অন্যদিকে মেধাবী ছাত্রদের যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো চাকরি নেই, কর্মের ব্যবস্থা নেই। একটি বিশেষ দলের ছাত্ররা ছাড়া কেউ যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না। যার দরুন রাজনীতি থেকে বিমুখ শিক্ষার্থীরাও বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।

রাজনীতিবিদদের উচিত ছাত্র রাজনীতির সুষ্ঠু ধারা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। যেমনটা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন— তা বজায় রাখা এবং একটা নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে ছাত্র রাজনীতিকে রাখা।

দেশপ্রেমিক অনেক ছাত্র-ছাত্রী দেশের এই অবস্থায় ও নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে, জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যেমনটা করেছিলো ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য এবং ১৯৭১ সালে দেশকে স্বাধীন করার জন্য।

ধর্ষণে সেঞ্চুরি উদযাপন, ক্যাম্পাসগুলোতে অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হাতে হত্যা, আওয়ামী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুম ও চোখ-হাত-পা হারানোর ভয়ে ছাত্রদের রাজনীতি বিমুখ হওয়া ও সার্বিক ছাত্র রাজনীতির উপর কালিমা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। প্রতিটি ক্যাম্পাসে মাফিয়া ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করে, সকল ছাত্র সংগঠনকে তাদের অধিকারের কথা নির্বিঘ্নে বলতে ও করতে দিলে এই সচেতন ও মেধাবী ছাত্র সমাজ আগামীর একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবীদ হবে। যারা দেশের উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

সুজন মোল্ল্যা
সাধারণ সম্পাদক
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

ছাত্ররাজনীতির নামে হত্যা-ধর্ষণের সংস্কৃতি যেকেউ ঘৃণা করবে
বুয়েটের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চায় না। খোলাখুলিভাবে বলতে গেলে ছাত্রলীগের রাজনীতি চাচ্ছে না। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ছাত্রসংগঠনটির গৌরবময় ঐতিহ্য আছে, কিন্তু সেই ঐতিহ্য তারা কতটুকু ধারণ করে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। নৃশংসভাবে আবরার ফাহাদের হত্যার ক্ষত বুয়েটের শিক্ষার্থীদের এখনো দুঃস্বপ্নে হানা দেয়।

সাম্প্রতিককালে ঢাবিতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের উপর অতর্কিত হামলা করে তাদেরই সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে রাজু ভাস্কর্য কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া, সিলেট এমসি কলেজে ধর্ষণ, জাবিতে ঘুরতে আসা বহিরাগত স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ, সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ২ কোটি টাকা চাঁদার কেলেঙ্কারি, যবিপ্রবিতে নিয়োগ পরীক্ষা দিতে আসা পরীক্ষার্থীদের হলে বন্দি করে মারধর ও পরীক্ষা দিতে না দেওয়া, সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, লুটপাটের মত শত শত ঘটনা বিভিন্ন ক্যাম্পাসে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে ছাত্র রাজনীতির মোড়কে।

ছাত্ররাজনীতির অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে সেই রাজনীতিকে যেকোনো বিবেকবোধ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ ঘৃণা করবে। বুয়েটের সচেতন শিক্ষার্থীরা ঠিক সেটাই করেছে।

রাজনীতি করা প্রতিটা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু রাজনীতির নামে যদি আবরারের মত মেধাবী দেশপ্রেমিক শিক্ষার্থীকে খুন হতে হয়, নারীদের সম্ভ্রমহানি হয়, সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজ ক্যাম্পাসে নির্বিঘ্নে স্বাধীনভাবে চলতে না পারে, গণরুম/গেস্টরুমে প্রিয় অভিভাবকের সহমত ভাইদের দ্বারা নির্যাতিত হতে হয়— তাহলে সময় এসেছে সেই গণতান্ত্রিক অধিকারের চৌহদ্দিকে সংকুচিত করার।

বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ‘নো পলিটিক্স ইন বুয়েট’ আন্দোলনে স্লোগান দিচ্ছে, এটাও রাজনীতির বাইরে না। এটাও ছাত্র রাজনীতির অংশ। বস্তুত, অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত সরকার দলীয় ছাত্রসংগঠনের ক্ষমতার ব্লাংকচেক ব্যবহার করে এই ফ্যাসিজমের চর্চা বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তেই বলবৎ থাকবে।

রাশেদ খান 
আহ্বায়ক 
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, যবিপ্রবি সংসদ।

ছাত্র সংগঠনগুলোর সন্ত্রাস-দখলদারীত্বের ফল রাজনীতি বিমুখ প্রজন্ম
ছাত্ররাজনীতিতে এ দেশের ছাত্রসমাজের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। এই সময়ে এসে ছাত্ররাজনীতি বাদ দেওয়ার জন্য ছাত্ররাজনীতির সেই অতীত ইতিহাস রচিত হয়নি। তাহলে এখন স্বাধীন দেশে সেই রাজনীতি এই বেহাল দশা কেনো? কেনো দিনে দিনে রাজনীতি বিমুখ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা?

তার উত্তর খুঁজলে দেখতে পাবো, সারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন (যখন যে ক্ষমতায় ছিল) যেভাবে সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব ও চাঁদাবাজের রাজনীতি চর্চা করছে— তাতে করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি ঘৃণা, ভয়, অশ্রদ্ধা তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই, ফলস্বরূপ আজকে আমরা রাজনীতি বিমুখ একটা প্রজন্ম দেখতে পাচ্ছি।

ক্ষমতাসীন দলের চাঁদাবাজি, লুটপাট, দুর্নীতি, টাকা পাচার, গুম, খুন— এগুলো বন্ধ না হলে ছাত্রদের এবং দেশের জনগণের  রাজনীতির প্রতি আস্থা তৈরি হবে না। তাই এই মুহূর্তে বুর্জোয়াদের শোষণমূলক রাজনীতি বিপক্ষে আদর্শবাদী রাজনীতি, জনগণের পক্ষের রাজনীতিকে শক্তিশালী করে তুলতে হবে। জনগণকেও সেই রাজনীতি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার আহ্বান থাকবে।

সোহাগী সামিয়া
সংগঠক
সমাজতান্ত্রিক ফ্রন্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence