জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার গল্প

অমৃত লাল রায়
অমৃত লাল রায়  © সংগৃহীত

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভুক্ত কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন অনেক তরুণ-তরুণী। আজ পড়ুন এমনই একজন— অমৃত লাল রায় এর গল্প। বর্তমানে তিনি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ লুইজিয়ানা এট লাফিয়েতে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করছেন। এর আগে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছেন অমৃত লাল রায়? দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে শুনিয়েছেন সেই গল্প—

উচ্চতর শিক্ষার বিষয়ে আমার স্বপ্নের শুরুটা হয় ২০১৬ সালে আমি যখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজধানীর খিলগাঁও মডেল কলেজে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়ি। প্রাথমিক অবস্থায় আমি এই বিষয়ে নানান দেশের বৃত্তি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করি। কিন্তু ইংরেজি বিষয়ে ফুল ফান্ড নিয়ে উচ্চতর শিক্ষায় অধ্যয়নরত কাউকে সেভাবে খুঁজে পাইনি বলে প্রাথমিক যে উৎসাহ ও আগ্রহ আমার ছিল সেটা অনেকটাই দমে যায়। ২০১৮ সালের মার্চে আমার স্নাতক শেষ হয়ে গেলে আমি ঢাকা সিটি কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হই। এখানে পড়াকালীন সময়ে শিক্ষকদের জ্ঞানের বিস্তৃতি আমার ওপরে এতটাই প্রভাব ফেলে যে আমি মনস্থির করি আমি উচ্চতর শিক্ষার জন্য আমি দেশের বাইরে চেষ্টা করব।

পরবর্তীতে আমি মাস্টার্সে পড়তে থাকা অবস্থাতেই আমারিকায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপে ও ওয়েবসাইটে তথ্য সংগ্রহ শুরু করি। সেসময়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য আমরা যারা আর্টস ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ছিলাম তাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা ছিল GRE পরীক্ষা। কিন্তু আমি দেশের বাইরের উচ্চতর শিক্ষা নেবার বিষয়ে খুবই ডিটারমাইন্ড ছিলাম। তাই প্রথমে GRE-এর পরিবর্তে, যেহেতু এটা আমার কাছে কঠিন মনে হচ্ছিল, IELTS প্রস্তুতি শুরু করবার মাধ্যমে আমার যাত্রা শুরু করি। ২০১৯ সালে আমি প্রথম বারের মত পরীক্ষায় বসি, এবং আমার কাঙ্ক্ষিত যে স্কোর তা আমি পেয়ে যাই।

আমার মাস্টার্স শেষ হয় ২০১৯ এর নভেম্বর মাসে। পরিবারে তিন ভাইয়ের মধ্যে আমি সবার ছোট এবং সবচেয়ে আদরের বলে মাস্টার্স শেষে আমি যখন বাসায় জানাই যে আমি দেশের বাইরে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যেতে চাই তখন পরিবারের সবাই এটাকে সাধারণভাবে নিতে পারছিল না, বিশেষ করে আমার মা একদম ভেঙে পড়েন। তবু আমি আমার নিজের মত করে যেসকল বিষয়ে আমার প্রস্তুতি ও জানাশোনার ঘাটতি রয়েছে সেসকল বিষয়ে ফোকাস করতে শুরু করি। এসবের মধ্যে করোনা চলে আসে এবং ঢাকা ছেড়ে আমাকে গ্রামে চলে যেতে হয়। গ্রামে কাটানো ৫ মাস সময় আমার জীবন অনেকটা বদলে দেয়, ঢাকায় আমার যে টিউশনগুলো ছিল সেগুলো সব চলে যায়, আমাকে নতুন করে আবার টিউশন খুঁজতে হয়। ঢাকায় ফিরে মনে হত প্রতিদিন আমি যেন আমার স্বপ্ন থেকে একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম। করোনা পরবর্তী সময়, ২০২০ এর অক্টোবর হতে ২০২৩ সালের মে মাসের ৩ তারিখ, যেদিন আমি প্রথম ফান্ডিং লেটার পাই, পর্যন্ত আমি আমার জীবনের সবচে কঠিন সময় পার করেছি। সেময়ে করোনার কারণে উচ্চতর শিক্ষার আবেদন ও ভর্তি প্রক্রিয়া একটু দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে চলে যায়। বাধ্য হয়ে আমি ২০২০ সালের শেষভাগে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে শুরু করি, প্রায় একবছর আমার সাধ্যের সবটুকু দিয়ে আমি চেষ্টা চালিয়ে যাই। পড়াশোনা আমার কাছে কখনওই খারাপ লাগেনি, এমনকি যে বিষয়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই সে বিষয় নিয়ে জানতেও আমার ভাল লাগে, কিন্তু চাকরির প্রস্তুতি নিতে গিয়ে যেসকল বিষয় পড়তে হয় এবং যে উপায়ে এগোতে হয় তা আমার একদমই ভাল লাগছিল না, রোজ মনেহচ্ছিল আমি এসবের জন্য একদম ফিট নই। একারণেই সম্ভবত একবছর আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করেও আমি সেভাবে কোথাও চাকরি নিশ্চিত করতে পারিনি।

২০২১ সালের অক্টোবরে আমি সরকারি চাকরির প্রস্তুতিতে ইস্তফা দিয়ে নিজের ভেতর থেকে যে ডাক আমি প্রায় ৫/৬ বছর ধরে শুনে আসছিলাম সে ডাকে সাড়া দিয়ে পুনরায় উচ্চতর শিক্ষার গ্রুপগুলোতে তথ্য সংগ্রহ করার কাজে ফিরে যাই। খেয়াল করছিলাম যে করোনা পরবর্তিকালীন সময়ে আমেরিকায় বেশিরভাগ বিশ্ব্যবিদ্যাল হিউম্যানিটিজে GRE'র বাধ্যতা তুলে দিচ্ছে। আবার একই সাথে এটাও চোখে পড়ছিল যে ইংরেজি নিয়ে ফুল ফান্ড যারা পেয়েছেন তারা সংখ্যায় নেহায়েত সামান্য। ইংরেজিতে ফুল ফান্ড নিয়ে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করছেন এমন দু-তিনজনকে খুঁজে পেলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি তখনো অব্দি কাউকে খুঁজে পাইনি। একই সাথে আমি যাদেরকেই জিজ্ঞেস করেছি ইংরেজিতে এবং তার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে ফান্ড পাওয়া সম্ভব কিনা তাদের প্রায় সকলেই আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম শুনে আমাকে নাসূচক অভিব্যক্তি জানিয়েছেন। তাই আমি তখন আমেরিকায় উচ্চশিক্ষায় স্বপ্ন স্তিমিত রেখে ইউরোপের নানান দেশ নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে শুরু করি। রাতদিন সব এক করে কোন এক নির্দিষ্ট দেশ নিয়ে সপ্তাহ ব্যাপী আমি কম্পিউটারের সামনে সময় কাটাই। উচ্চতর ডিগ্রির সুযোগ আছে এমন সকল দেশ সম্পর্কে তিন মাসের মধ্যেই আমার একটা মোটামুটি ধরনের ধারণা হয়ে যায়। ইউরোপের দেশগুলোতে Erasmus Mundus স্কলারশিপের বাইরে কিছু কিছু দেশের তাদের নিজেদের স্কলারশিপ রয়েছে, কিন্তু সেই স্কলারশিপগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক যে যোগ্যতার উল্লেখ আছে সেসব আমার ছিল না। তাই আমি নরওয়ে এবং জার্মানিতে এপ্লাই করবার মানসিক প্রস্তুতি নিতে আরম্ভ করি যেহেতু এই দুটি দেশে টিউশন ফি ছিল না এবং সপ্তাহে পড়াশোনার বাইরে ২০ ঘণ্টা কাজের অনুমতি রয়েছে যা দিয়ে থাকা খাওয়ার খরচ বহন করা সম্ভব। জার্মানিতে এপ্লাই করতে গিয়ে খেয়াল করলাম ওখানে আমি ভর্তি হবার সুযোগ পেলেও করোনার কারণে দূতাবাসে বেশ ভাল রকমের জট লেগে গেছে, এবং ইন্টার্ভিউ ডেট পেতে প্রায় ১৮ মাসের মত অপেক্ষা করতে হয়, যেটা আমার কাছে একদমই বাস্তবতাসম্মত মনে হয়নি। এরপরে আমি নরওয়েতে এপ্লাই করবার প্রস্তুতি নিতে থাকি। ওখানে টিউশন ফি ছিল না উচ্চতর শিক্ষায়, এবং দূতাবাসে ইন্টার্ভিউ দিতে খুব একটা বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না জার্মানির মত। এখানে এপ্লাইয়ের সময়ে ১২ লাখ টাকা ব্যাংক একাউন্টে দেখাতে হয় এবং যার একাউন্ট তার থেকে একটা স্পন্সরশীপ লেটার নিতে হয়। প্রাথমিক ভাবে আমার এক বন্ধুর সাথে কথা হয়, ও আমাকে ওর একাউন্টে এই টাকা দেখাতে রাজি হয়। কিন্তু বিধি বাম, এপ্লাই এর সময় ঘনিয়ে এলে নরওয়ে নতুন আইন পাশ নিয়ে ভাবতে শুরু করে, প্রথমবারের মত নরওয়ে টিউশন ফি আরোপ নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে এটা সেদেশের গণমাধ্যম জানায়। এই পরিস্থিতিতে আমি পড়ে যাই অথই সাগরে...

আমি এরপরে বুঝতে পারছিলাম না আমার কি করা উচিত, কারণ আমি ততদিনে সরকারি চাকরির পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি, উচ্চতর শিক্ষার জন্য পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাই ফিরে তাকাবার কোন পথ আর ছিল না। আমার হাতে তখন আমারিকায় এপ্লাই করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার কারণে যাকেই এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছি সেসময়ে সবাই আমাকে বলেছেন আমার আসলে ফুল ফান্ড পাবার সুযোগ নেই বললেই চলে! তবু নিজের ওপরে ভরসা রেখে আমি এগোতে চাইছিলাম। IELTS মেয়াদ ততদিনে আমার শেষ হয়ে যায়, আমি আবার পুনরায় এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। 

আমেরিকায় ইংরেজিতে ফান্ড পাবার ক্ষেত্রে রাইটিং স্যাম্পলের গুরুত্ব অপরিসীম, তাই আমি আমার রাইটিং স্যাম্পল তৈরি করার কাজে হাত দেই ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে। একই সাথে SOP তৈরি করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজতে শুরু করি। ফান্ড পাবার ক্ষেত্রে আমার কাছে সবচে গুরুত্বপূর্ণ মনেহয়ছে এই কাজটা, নিজের প্রোফাইলের সাথে সামঞ্জস্য আছে এমন বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পেলে খুব বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করবার দরকার পড়ে না। যেমন আমি  তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাই করে দুইটি থেকেই ফান্ড পেতে সক্ষম হই। রাইটিং স্যাম্পল তৈরী করতে গিয়ে আমাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়েছিল, জাতীয়  বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে কোন থিসিস কিংবা টার্ম পেপার করানো হয়না, মাস্টার্সে ২ ক্রেডিটের টার্ম পেপার করানো হলেও আমার কাছে সেটা পরিপূর্ণ স্কলারলি মনেহয়নি। তাই আমার নতুন করে রাইটিং স্যাম্পল তৈরি করা যৌক্তিক মনে হয়েছিল এবং প্রাথমিক অবস্থায় আমি বুঝতে পারছিলাম না যে এই বিষয়ে কার কাছ থেকে দিক নির্দেশনা নেয়া যায়। কিছুদিন ভেবেচিন্তে আমি সিটি কলেজে আমার শিক্ষক ডক্টর এলহাম হোসেন স্যারের দিক নির্দেশনায় কাজ শুরু করি, এবং স্যারের সাহায্য নিয়ে আমি আমার রাইটিং স্যাম্পল বেশ ভালভাবে সম্পন্ন করতে সফল হই। এর পরবর্তী ধাপ ছিল রিকমেন্ডেশান লেটার জোগাড় করা, কিন্তু রিকমেন্ডেশান লেটার চাইতে গিয়ে প্রথমে আমাকে বেশ বিপাকে পড়তে হয়। আমেরিকায় যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে গেলে দুই থেকে তিনটা রিকমেন্ডেশান লেটারের প্রয়োজন হয়। 

আমি প্রথমে আমার যে শিক্ষকের কাছে রিকমেন্ডেশান লেটার আনতে যাই উনি আমাকে বলেন আমার আমেরিকায় কোন ধরনের ফান্ড পাবার সম্ভাবনা একদমই নেই, তাই উনি ওনার মূল্যবান সময় খরচ করে আমাকে আমেরিকার জন্য রিকমেন্ডেশান দিবন কিনা সেটা ওনাকে ভাবতে হবে। এই কথা শোনার পরে আমি মানসিকভাবে একদম ভেঙে পড়ি, আমি দেশে যাদের কাছে আমেরিকায় আবেদন নিয়ে পরামর্শ চেয়েছি তাদের প্রায় সকলেই এর কাছাকাছি ধরনের কথা বললেও আমি নিজের আত্মবিশ্বাসকে দমে যেতে দেইনি, কিন্তু আমি যেই স্যারকে স্নাতকের পুরো সময়টা আইডোলাইজ করে এসেছি তার থেকে এই কথা শুনে আমি আমার আত্মবিশ্বাসকে না টলে যেতে দিয়ে আর পারিনি। এর পরবর্তি ৭ দিন সবচে দুর্বিষহ সময় পার করেছি। 

ফল সেশনে এপ্লাই করবার জন্য নভেম্বর এবং ডিসেম্বর হল সবচে গুরুত্বপূর্ণ সময়, এবং সেই নভেম্বরে স্যারের এই কথা শুনে আমি ৭ দিন মন খারাপ করে রুম থেকে বের হইনি। এরপরে আমি ফেসবুকে NexTop-USA (Higher study in USA) গ্রুপে পোস্ট করি এই লিখে যে আমার প্রোফাইল নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট হয়ে আমেরিকা থেকে ফান্ড পাওয়া সম্ভব কিনা! ঐ পোস্ট ছিল আজকে আমার আমেরিকা আসার পেছনে সবচে বড় অনুপ্রেরণা, কমেন্টে আমাকে সবাই এত দারুণভাবে উতসাহ জুগিয়েছে যে এরপরে আমি ফান্ড পাবার আগ পর্যন্ত এক ঘণ্টা সময়ও নষ্ট করিনি। এই গ্রুপ থেকে আমি যে পরিমাণ সাহায্য ও অনুপ্রেরণা পেয়েছি যে আমি যাই বলিনা কেন তা তাদের সাহায্যের তুলনায় অসম্পূর্ণ মনে হবে, আমার মনেহয় আমি এই গ্রুপের মেম্বার, মডারেটর, ও এডমিনদের সাহায্য ছাড়া আজকের এই যায়গায় পৌঁছাতে পারতাম না। এর বাইরে আমার কিছু বন্ধু রয়েছে যারা সবসময়েই আমার সঙ্গে থেকে বলেছে আমি পারবো, আমার আমেরিকায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করবার সকল সম্ভাবনা রয়েছে, এবং ওরা প্রায়শই একটা কথা বলে আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়া আমার উচ্চতর শিক্ষার পেছনে কোন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। আমার পরিবারে আমার বড় দুই ভাই বাবার অনুপস্থিতিতে তাদের সবটা দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছেন এবং সাধ্যের সবটুকু দিয়ে আমাকে আজকের এই জায়গায় নিয়ে আসার জন্য পরিশ্রম করে গেছেন। পরিবারের পাশাপাশি উল্লিখিত বন্ধুগুলো আমার পাশে আমার সবচে খারাপ সময়ে না দাঁড়ালে আমার জন্য ফুল ফান্ড নিয়ে উচ্চতর শিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করবার পথটা আরো অনেক বেশি কঠিন হত। আমার এই অর্জনে আমার থেকেও আমার বড় দুই ভাই এবং এই বন্ধুগুলো বেশি খুশি হয়েছে, যেটা এই অর্জনের থেকেও আমার কাছে বেশি মূল্যবান ও আনন্দের মনেহয়।

আমেরিকায় আবেদন করা অন্যান্য দেশের তুলনায় আমার কাছে কিছুটা বেশি সিস্টেমেটিক মনে হয়েছে। জাতীয় পরিচয় পত্র, পাসপোর্ট এবং সকল সার্টিফিকেটে নিজের তথ্য সব এক না থাকলে প্রথমে সেগুলোকে এক করে নিতে হবে। আমার যেমন জাতীয় পরিচয়পত্রে মায়ের নাম একটু অন্যরকম ছিল, তাই আমি পাসপোর্ট করবার পূর্বেই সেটা সংশোধন করে নিয়েছিলাম। এরপরে আসে অরিজিনাল সার্টিফিকেট এবং ট্রান্সক্রিপ্টস তোলার প্রসেস শুরু করা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কাজগুলো এখন খুব সহজেই অনলাইনের মাধ্যমে করে ফেলা যায়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাগজ ওঠানোর কথা শুনলেই আমাদের মনের মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করে, কিন্তু আমার কাছে বরং মনেহয়ছে পুরো জার্নির সবচে কম স্ট্রেস-ফ্রি ধাপ ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সকল কাগজ তোলা এবং সেগুলোর সত্যায়িত কপি সংগ্রহ করা। কাগজ পত্র রেডি হয়েগেলে এরপরে নজর দেয়া উচিৎ স্টেটমেন্ট অফ পারপাস (SOP) এর দিকে, কারণ আমার মত যাদের সিজিপিএ কম, আমার স্নাতক এবং স্নাতোকোত্তর দুটোতেই ৩.০৬ ছিল, তাদের জন্য এই ১০০০ শব্দ হল সবচে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিজেকে উচ্চতর শিক্ষার যোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করবার জন্য। SOP লেখার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন জিনিসগুলো আমাকে সাহায্য করবে, সেই বিষয়গুলোতে আমি কিভাবে নতুন কিছু সংযুক্ত করতে পারবো, এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার কাজ ও প্রচেষ্টার মেলবন্ধনে যে উন্নয়ন ঘটবে সেটা নিজের দেশে ফিরে এসে আবার কিভাবে কাজে লাগাতে পারবো - এই তিনটা বিষয়ের ওপরে আমি জোর দিয়েছিলাম। যাদের রাইটিং স্যাম্পল জমা দেয়ার রেকয়ারমেন্ট আছে তাদের জন্য ফান্ড ম্যানেজ করবার অন্যতম হাতিয়ার হল এটা, ১৫ থেকে ২০ পেজের স্কলারলি রাইটিং পড়ে এডমিশান কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় আমাদের বিশ্লেষণ করবার সামর্থ্য কেমন এবং কতটা। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে যতটুকু বুঝেছি তাতে আমার ধারনা ইংরেজিতে ফান্ড পাবার সম্ভাবনার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ নির্ভর করে রাইটিং স্যাম্পল এবং স্টেটমেন্ট অফ পারপাসের ওপরে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গ্রুপ রয়েছে National University Research and Higher Study Association নামে, যেখান থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চাইলে রাইটিং স্যাম্পল, রিসার্স এবং উচ্চ শিক্ষার বিষয়ে পরামর্শ এবং গাইডলাইন্স পেতে পারেন।

দেশে থাকতে একটা কথা প্রায়শই শুনতাম, আমেরিকা ইজ দ্যা ল্যান্ড অফ অপারচুনিটিজ। এই কথার সত্যতা এখানে এলে প্রতিদিন বোঝা যায়, আমি এখানে আসার দু সপ্তাহের মাঝে একটা প্রতিষ্ঠান থেকে পিএইচডির সুযোগ পাই, আমার পছন্দের ফিল্ড নিয়ে এখনো নিশ্চিত নই বলে ওখানে পিএইচডির বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবার রিসোর্স থেকে শুরু করে শিক্ষকদের গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টসদের কলিগ সম্বোধন করার মত বিষগুলো এত অনুপ্রেরণাদায়ক যে বাংলাদেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি পড়াশোনার চাপ থাকা স্বত্বেও এখানের পড়াশোনা খুব একটা অস্বস্তির মনে হয়না।পড়াশোনার সাথে আমি এখানে গ্রাজুয়েট টিচিং এসিট্যান্ট হিসেবে প্রথম সেমেস্টারে রাইটং ল্যাবে লাজ করছি, যেখানে আমি শিক্ষার্থীদের রাইটিং উন্নয়নে টিউটিওরিং করছি এবং পরবর্তী সেমেস্টার থেকে ইংরেজি মেজর আন্ডারগ্রাড স্টুডেন্টসদের ক্লাস নেয়া শুরু করবো। রাইটিং ল্যাবে আমাদের ডিরেক্টর সার্বক্ষণিক দিক নির্দেশনার সাথে সাথে আমাদের যাতে ল্যাবে বোরিং না লাগে সেজন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে নাস্তা থেকে শুরু করে ফিগেট স্পিনারের মত রিক্রিয়েশনাল টুলস এর ব্যবস্থা করে রেখেছেন।  পাশাপাশি এখানে বাংলাদেশি স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন এত দারুণ যে নতুন স্টুডেন্সদেরকে বাসা খোঁজা থেকে শুরু করে বাজার করে দেবার মত বিষয়গুলো তারা সামাল দিচ্ছেন। এখানে আসার পূর্বে বাংলাদেশে বসে  এখানে এসে কোথায় উঠবো, কিভাবে সব ম্যানেজ করবো এগুলো নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম, কিন্তু বাংলাদেশি স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের সবাই, স্পেশ্যালি প্রেসিডেন্ট আরমান রিয়াজ ভাই যেভাবে আমাদের জন্য সবকিছু ম্যানেজ করেছেন তাতে আমেরিকা যে আমাদের জন্য নতুন জায়গা সেটা মনে হচ্ছে না, এবং পরিবারের অভাবও তারা সেভাবে আমাদেরকে বোঝার সুযোগ দিচ্ছেন না প্রত্যেক উইকেন্ডে কিছু না কিছু আয়োজন করবার মধ্য দিয়ে।

শেষ করবো এই বলে যে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণ করা উচ্চতর শিক্ষার পথে আমারিকায় সেভাবে কোন বাধা নয়, উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে কারো আগ্রহ ও স্বপ্ন থাকলে এবং সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য লেগে থাকলে আমেরিকায় যে কোন বিষয় নিয়েই ফুল ফান্ড পাওয়া সম্ভব। তাই স্বপ্ন যাদের আকাশ ছোঁয়ার তাদের হারাবার সামর্থ্য শুধু তাদের নিজেদের বাদের আর কারো নেই। খিলগাঁও মডেল কলেজের শিক্ষক থেকে শুরু করে আমার সহপাঠীরা সকলেই আমাকে আজকের এই যায়গায় পৌঁছানোর পেছনে কোন না কোনভাবে সাহায্য করেছেন, তাদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। একই সাথে আমি সমানভাবে ঋণী ঢাকা সিটি কলেজের কাছে, ওখানে কাটানো এক বছর আমাকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখবার সাহস জুগিয়েছে, প্রত্যেক শিক্ষক আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে জ্ঞানের সাগরে সাহস করে নেমে পড়তে হয়। 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence