বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি

নারীকে সাহসের সঙ্গে লড়াইটা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নিতে হবে

মৌলি আজাদ
মৌলি আজাদ  © টিডিসি ফটো

বিগত কয়েক দশকে নারী শিক্ষায় আশানুরূপ অগ্রগতি করেছে বাংলাদেশ। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনেও বেড়েছে নারীদের পদচারণা। তবে শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও এখনও তাদের জন্য নিরাপদ হয়নি শিক্ষাঙ্গন। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত নারী শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেকেই। কখনও সহপাঠীর দ্বারা আবার কখনও শিক্ষকের দ্বারা। ভুক্তভোগীরা জানান, নতুন কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান বা বলে বেশিরভাগ সময় এসব ঘটনা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেন। আবার অনেক সময় অভিযোগ জানালেও বিচার মেলে না। শুধু নারী শিক্ষার্থীরাই নন, অনেক সময় নারী শিক্ষকেরাও এ ধরণের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। 

সর্বশেষ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, প্রশাসনকে অভিযোগের বিষয়ে তারা জানালেও তদন্তকার্যে গড়িমসি করা হচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর নিরাপত্তার এই অনিশ্চয়তা নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপ-পরিচালক মৌলি আজাদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া—

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেলেও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। নারী নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইউজিসির পরিকল্পনা কি?
মৌলি আজাদ: আমাদের সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও সমাজ এখনও নারীকে একজন মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে শেখেনি। এর ফলেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নারীর এধরণের হয়রানি প্রতিরোধে ইউজিসি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন নির্যাতন প্রতিকার সেল গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নারী শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী যৌন হয়রানির শিকার হলে তারা সংশ্লিষ্ট সেলে অভিযোগ জানাবেন এবং দায়িত্বরত ব্যক্তিরা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তে গড়িমসির অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়টি ইউজিসি কিভাবে দেখছে?
মৌলি আজাদ: খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল তদন্ত কমিটি সঠিকভাবে গঠন করা হয়নি। আমরা আইন পর্যালোচনা করে দেখতে পাই তাদের তদন্ত কমিটি সঠিকভাবেই গঠিত হয়েছে। পরবর্তীতে আমি ভুক্তভোগীর সাথে যোগাযোগ করি এবং প্রয়োজনে তাকে ইউজিসির নিকট অভিযোগ জানাতে বলি। সে এ বিষয়ে ইউজিসিতে অভিযোগ করেনি, তাই ইউজিসির পক্ষ থেকেও কোনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি আমরা যখনই জানতে পেরেছি তাদেরকে এ বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা জানানোর জন্য চিঠি প্রদান করেছি। তাদের উত্তরের প্রেক্ষিতে ইউজিসি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। শুধু এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, আমরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই এ ধরনের অভিযোগের বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার। তবে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইউজিসিকে বিষয়গুলো তো জানাতে হবে, কোনো বিষয়ে জানানো না হলে ইউজিসি কর্তৃপক্ষেরতো জানার সুযোগ নেই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীরা বলছেন যখন কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করা হয় তখন নামমাত্র শাস্তি প্রদান করা হয়। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
মৌলি আজাদ: আমি এ ধরনের বেশ কয়েকটি কমিটিতে ছিলাম। যেসব অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে পদাবনতি কিংবা চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি অনেক সময় ভুক্তভোগী সাক্ষাৎগ্রহণের সময় উপস্থিত থাকেন না। কিংবা শেষ পর্যন্ত অভিযোগটি চালিয়ে নেন না। একজন নারীর ওপর যেহেতু বেশিরভাগ সময় সামাজিক ও পারিবারিক চাপ থাকে এ কারণেই হয়ত তারা শেষ পর্যন্ত তাদের অবস্থানে অনড় থাকতে পারেন না। আর পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে তখন অভিযুক্তকে শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হয় না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন নারী যৌন হয়রানির মত ঘটনার সম্মুখীন হওয়ার পর অনেকসময়ই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতিতে নারীকে কাউন্সেলিং করানোর মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এ বিষয়ে ইউজিসি কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে কি?
মৌলি আজাদ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটির মনিটরিং এর জন্য ইউজিসির মনিটরিং সেল রয়েছে। সেলে জনবল সংকট থাকায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তাদের অবস্থা সরাসরি পর্যবেক্ষণ সবসময় সম্ভব হয় না। তবে ইউজিসি সবসময় চেষ্টা করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় সেটি নিশ্চিত করতে। কাউন্সেলিংয়ের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গিয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করে কাউন্সেলিংসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। আশা করছি, ক্রমান্বয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও এই সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি ইউজিসির গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে দায়িত্ব পালন করছেন, একইসঙ্গে নারী অধিকার নিয়েও কাজ করছেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
মৌলি আজাদ: আমাদের নারীরা শিক্ষিত হচ্ছে, চাকরি করছে। কিন্তু এখনও দেখা যায় নিজের উপার্জিত অর্থ নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী ব্যয় করতে পারে না। নারীর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। নিজের ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে তার যেন অন্যের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকতে না হয়। নিজের অধিকার নিয়ে তাদেকেই সরব হতে হবে। কেউ যৌন হয়রানির শিকার হলে সমাজের চিন্তায় সেটা আড়াল না করে অভিযোগ জানাতে হবে এবং শেষ পর্যন্ত সাহসের সঙ্গে লড়াইটা চালিয়ে নিতে হবে। আর জীবনে যত কঠিন পরিস্থিতিই আসুক না কেনো কখনও আত্মহত্যা বা নিজের ক্ষতি করার চিন্তা করা যাবে না, পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
মৌলি আজাদ: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।


সর্বশেষ সংবাদ