বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদ কি শুধু শিক্ষকদের জন্যই সংরক্ষিত?
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২০, ১১:৪৬ PM , আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২০, ১১:৪৬ PM
রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) রেজিস্ট্রার শেখ রেজাউল করিমকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়ার পর এর তীব্র সমালোচনা শুরু করেছে শিক্ষকদের সংগঠনগুলো। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি এবং সবগুলো সমিতির ফেডারেশন এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে বিবৃতি দিয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্তে উষ্মা প্রকাশ করেছে উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদও।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পদে মূলত প্রশাসনিক কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে, উপাচার্য পদের দায়িত্ব পান প্রধানত অধ্যাপক পদমর্যাদার শিক্ষকরা। উপাচার্য বা ভাইস-চ্যান্সেলর (ভিসি) পদটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহীর পদ।
শেকৃবির নতুন উপাচার্যকে দায়িত্ব দেওয়ার পর শিক্ষকদের সংগঠনগুলো বলছে, উপাচার্যের শূন্য পদে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়ার ঘটনা আগে কখনো ঘটেনি।
আবার কোনো কোনো শিক্ষক সমিতি বলেছে যে এ ধরণের আদেশ উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ধারণার সাথে অসঙ্গতিপূর্ণই নয়, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদের প্রতিও অবমাননাকর।
তবে শেকৃবির রেজিস্ট্রারকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য করার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সংগঠনগুলো।
অবশ্য বিতর্কের রাশ টানতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের পদ খালি থাকায় রুটিন কাজের জন্য রেজিস্ট্রারকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এবং শিগগিরই নিয়মমাফিক উপাচার্যসহ অন্যদের নিয়োগ দেয়া হবে।
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে মোট ৩৭টি, অর্থাৎ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জনগণের করের অর্থে পরিচালিত হয়।
শেকৃবি ছাড়াও ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েও কর্তব্যরত রেজিস্ট্রারকে সেখানকার ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে, যে সিদ্ধান্তে 'আনন্দ প্রকাশ' করেছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সংগঠন।
শিক্ষকরাই ভিসি হবেন?
শেকৃবিতে একজন কর্মকর্তাকে উপাচার্যের দায়িত্ব দৌযার পর যেসব শিক্ষক সংগঠন সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে, তার মধ্যে অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লুৎফর রহমান বলছেন, প্রাকটিস হলো উপাচার্য হবেন শিক্ষকদের মধ্য থেকেই। কিন্তু এর যে ব্যত্যয় ঘটেছে, তাকে তিনি দুঃখজনক বলে বর্ণনা করেন।
‘চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলে। বাকী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিন্তু এর আওতায় নয়। কিন্তু প্রাকটিস হলো উপাচার্য হবেন একজন শিক্ষক’।
লুৎফর রহমান বলেন, তারা দাবি করেন যে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে উঁচু পদে একজন শিক্ষক থাকাই বাঞ্ছনীয়, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান বিতরণ ও চর্চার জায়গা।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-পন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল থেকে শিক্ষক সমিতিতে নির্বাচন করে সহ-সভাপতি হয়েছেন। পরে সমিতির সভাপতি মাকসুদ কামাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে তিনিই ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এমরান কবির চৌধুরীর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবল কাঠামো অনুযায়ী রেজিস্ট্রার একজন অধ্যাপকদের সম-মর্যাদার নন।
তিনি বলেন, এখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও ছাত্রদের বিষয় জড়িত। ভিসি পদটিকে শুধু প্রশাসনিক পদ ভাবলেই হবে না। জ্ঞানের চর্চার বিষয়টি এখানে গভীরভাবে জড়িত। আবার প্রতিনিয়ত ছাত্রদের নানা বিষয় দেখভাল করা একজন শিক্ষকের পক্ষেরই সম্ভব। এখানে নেতৃত্বের বিষয়টি শিক্ষকদের হাতে থাকাই কাম্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেন যে একজন উপাচার্যকে ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, গবেষক, স্টাফ এবং সিনেটে থাকা জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের নেতৃত্ব দিতে হয়।
‘বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার এটি একটি জটিল দিক, যা একজন শিক্ষকের পক্ষেই পালন করা সম্ভব। কারণ একজন শিক্ষক প্রশাসক হতে পারেন, কিন্তু একজন প্রশাসকের পক্ষে শিক্ষক হওয়া সম্ভব হবে না’।
প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আমীরুল ইসলাম বলেন, এক সময় পণ্ডিত শিক্ষাবিদরা উপাচার্য হতেন এবং তাদের সবাই সম্মান করতো।
তিনি বলেন, আমি আমি ৩১ বছর চাকরী করি। আগে যখন ভিসি-প্রোভিসি পদে রাজনৈতিক নিয়োগ কম হতো, তখন রেজিস্ট্রাররাই কিন্তু সব ম্যানেজ করতেন। সবচেয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাই তিনি। কিন্তু এখন ভিসি হওয়া নিয়ে যে প্রতিযোগিতা হয় শিক্ষকদের মধ্যে, যেভাবে লবিং হয়, তা এখন সবাইকে বিরক্ত করছে। ফলে রাষ্ট্রপতি যদি যোগ্য অন্য কাউকে দায়িত্ব দেন, তাতে অসুবিধা কোথায়।
তিনি আরও বলেন, বিচারপতিরাও উপাচার্য হয়েছেন আবার শিক্ষাবিদরাও হয়েছেন। নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান কোথায় নেমেছে, সেটা সবাই জানে। আমরা চাই শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালন করুন। কর্মকর্তাদের প্রশাসন চালানোর মতো যোগ্যতা দক্ষতা থাকলে সরকার তো এটা (রেজিস্ট্রারকে উপাচার্য নিয়োগ) দিতেই পারে।
‘শিক্ষক নিয়োগে নানা অনিয়মের অভিযোগ তো হরহামেশাই শোনা যাচ্ছে। এখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা, ছাত্র সবাই মিলে দেশ গড়ার মানুষ তৈরি করবো, কিন্তু সেটি আর হচ্ছে না’।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জিনাত আমান যুক্তি হলো, শুধু শিক্ষকরাই উপাচার্য হবেন, বর্তমানের "এই কালচার থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
‘বিষয়টি এমন এক-কেন্দ্রীক হবে কেন? অফিসাররাও তেমন যোগ্যতার হলে দায়িত্ব পেতে সমস্যা কোথায়?’ - প্রশ্ন রাখেন তিনি।
জিনান আমান বলেন, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স ফেডারেশন শেরেবাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। ‘আমাদের ভেতরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে,’ জানান তিনি।
কিন্তু অন্য কেউ ভিসি হতে পারেন?
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক এমরান কবির চৌধুরী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভিসি হিসেবে বিচারপতিরাও কাজ করেছেন। এছাড়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বাইরে থেকে উপাচার্য নিয়োগের উদাহরণ রয়েছে। প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যদের নামের তালিকায় বিচারপতি হামুদুর রহমান ও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নাম রয়েছে।
এমরান কবির চৌধুরীর মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছাত্ররা এবং তাদের ঘিরেই চলে সব আয়োজন।
‘কিন্তু শিক্ষার্থীদের বোঝা বা তাদের কোনো বিষয় হ্যান্ডেল করা - এসব ব্যাপার শিক্ষক ছাড়া অন্য কারও পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভব নয়। উপাচার্য পদটি ঠিক অন্য প্রশাসকদের মতো নয়,’ বলছিলেন তিনি।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তাদের নেতা আমীরুল ইসলাম মনে করেন যে যোগ্যতাই নেতা তৈরি করে এবং যোগ্য ব্যক্তি পাওয়া গেলে যে কোনো পেশার ব্যক্তিই উপাচার্য হতে পারেন। তিনি বলেন, এটি হলে উপাচার্য নিয়োগ পেতে শিক্ষকদের প্রতিযোগিতা অনেকাংশে কমে এসে শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশকে সুস্থ করে তুলবে।
আর জিনাত আমান বলেন, উপাচার্য হবেন এমন কেউ, যিনি হবেন ‘সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য’।
ভিসি নিয়োগ কিভাবে হয়?
১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট কর্তৃক তিনজনের একটি উপাচার্য প্যানেল নির্বাচিত হয় এবং সেখান থেকে উপাচার্য নিয়োগ দেন চ্যান্সেলর, অর্থাৎ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে এর ব্যতিক্রমও আছে এবং তা হলো, অনেক সময় সরকার তার পছন্দনীয় ব্যক্তিকে সরাসরি নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় আড়াই দশক সময় ধরে কোন উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হয়নি। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝেমধ্যেই সরকার মনোনীত ব্যক্তিকে সরাসরি ভিসি পদে নিয়োগ দিয়েছেন চ্যান্সেলর।
ফলে গত প্রায় তিন দশক ধরে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক পরিচয়, ফলে তৈরি হচ্ছে নানা বিতর্ক। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ হয় মালিকদের ইচ্ছে অনুযায়ী।
শিক্ষকরা মনে করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনভাগের এক ভাগেরও কম শিক্ষক সরাসরি রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে সক্রিয়। অন্যদিকে, উপাচার্য হওয়ার পরে অনেকেই রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট থেকেছেন।
উপাচার্য নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয়ের ঢামাঢোল এড়াতে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সার্চ কমিটির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলো। তবে বলা হয়েছিল, স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই প্রক্রিয়ার বাইরে থাকবে। পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই কমিটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
সূত্র: বিবিসি বাংলা