তারুণ্যের মেধা দমিয়ে রাখা যাবে না
- মো. আবু রায়হান
- প্রকাশ: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৯:৪০ PM , আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১০:০২ PM
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ দীর্ঘ সময়ের একটি আন্দোলন। যে আন্দোলনটি এদেশের লক্ষ কোটি তারুণ্যের অস্তিত্ব রক্ষা তথা টিকে থাকার আন্দোলন। বড় আফসোসের বিষয় দু’চারজন আমলা আর রাজনীতিবিদের গড়িমসির কারণে ৩৫ এর দাবি আলোর মুখ দেখছে না। জোর করে তারুণ্যের শক্তি ও মেধাকে দমিয়ে রাখাটা তাদের যেন অভিলাষে পরিণত হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ এর উপরে। শুধু বাংলাদেশই ভিন গ্রহের দেশ হিসেবে বয়স রাখা হয়েছে ৩০। যা রীতিমতো অযৌক্তিক ও সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের বরখেলাপ।
বিভিন্ন সময়ে চাকরিতে বয়স বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও অজানা কারণে অদৃশ্য শক্তির ইশারায় তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বয়স বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেওয়া হলেও নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার পর তারা বেমালুম ভুলে আছেন। এখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি করা মনে হচ্ছে তাদের জন্য এলার্জি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন অযৌক্তি-কুযুক্তি দেখিয়ে ৩৫ এর দাবিকে নাকচ করছেন। যদি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ৩০ এর উপর বয়স বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে, তাহলে আমাদের বয়স বৃদ্ধিতে এতো অজুহাত ও কালক্ষেপণ কেন? আপনারা কথায় কথায় দেশটাকে কানাডা, সিঙ্গাপুর, জাপান আবার কখনো কখনো সুইজারল্যান্ড বানিয়ে দেন। এগুলো শুনতে বড়ই অদ্ভুত শোনায়।
এ সমস্ত দেশ তারুণ্যের বয়স ৩০ এর ফ্রেমে বেঁধে রেখে এত উন্নত হয়নি। তারা তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আজ উন্নত দেশ হয়েছে।
বাংলাদেশের বিশাল তরুণ সমাজকে ৩০ বছর হলেই উপেক্ষা করা হয়। ছাব্বিশ বছরে অর্জিত সনদপত্র ৩০ বছরে উত্তীর্ণ হলেই আস্তাকুঁড় নিক্ষেপ করেন। তারুণ্যের স্বপ্ন আঁতুড়ঘরেই হত্যা করেন। সেখানে উন্নত রাষ্ট্র গড়ার এ দাবী জনগণের সঙ্গে মশকরার শামিল ও হাস্যকর।
৩৫ আন্দোলনকারীরা তারা চাকরি চায় না। তারা চায় চাকরিতে আবেদনের সুযোগ মাত্র। এ সুযোগ তাদের দিন। পারলে তারা উত্তীর্ণ হয়ে দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করবে। না পারলে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে এলাকায় গিয়ে তারা মাছ চাষ, ক্ষেত খামারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করবে। কিন্তু তারুণ্যের ৩৫ এর সুযোগ ও স্বপ্ন আপনারা গলাটিপে হত্যা করতে পারেন না। এ অধিকার আপনাদের নেই এবং তা আপনাদেরকে দেওয়াও হয়নি।
গণতান্ত্রিক দেশে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এদেশে জনমতের ছিটেফোঁটা আমরা দেখিনা। আজ দেশে কত বর্ষীয়ান ও প্রবীণ ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখছেন। সরল বিশ্বাসে দুর্নীতি অপরাধ হবে না বলে ফতোয়া দিচ্ছেন। ঘুষ সহনীয় পর্যায়ে খেতে উপদেশ দেওয়া হয়। সেখানে তারুণ্যের শক্তি করছেন অবজ্ঞা। সিনিয়র সিটিজেনদের বয়স বাড়িয়ে আবারো তাদের চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে জাতিকে উদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তৃণমূলে তারুণ্যকে উপেক্ষা করে বিকল্প দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরির পরিবর্তে সিনিয়রদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এতে আগামী দিনে দক্ষ যোগ্য নেতৃত্ব হারাবে বাংলাদেশ। ৩৫ আন্দোলন কারীরা সফল না হলে, আন্দোলন করে রাজনীতি শিখতে পারবে বলে মন্তব্য করা হয়। তারা ভালো ভাবেই জানে রাজনীতি আজ কাদের দখলে? এদেশের তরুণ যুবা তথাকথিত এ নোংরা রাজনীতিকে মন থেকে ঘৃণা করে। কারণ রাজনীতি এখন দুর্বৃত্ত মাস্তান চাঁদাবাজদের নিয়ন্ত্রণে।
এখানে রাজনীতিতে অপরাধীদের শেল্টার দেওয়া হয়। ভালো মানুষের জন্য বর্তমানে রাজনীতি করাটা টাফ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা টিকেও থাকতে পারেন না। সেই রাজনীতি শেখার ছবক দেওয়া হয় ৩৫ আন্দোলনকারীদের? তরুণদের মধ্যে আজ আর কেউ রাজনৈতিক নেতা হতে চায় না। রাজনীতির প্রতি যেন তাদের আজন্ম ঘৃণা। তারা হতে চায় ডাক্তার, প্রকৌশলী, উকিল, বিচারক, অর্থনীতিবিদ ভালো মানুষ। কেউ রাজনীতিবিদ হতে চায় না। কারণ তারা হালুয়া রুটিতে আসক্ত না। কিছু মানুষের কাছে রাজনীতি পেশা ও বিনা পুঁজিতে মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।
আজ ৩৫ এর জন্য যারা আন্দোলন করছেন তারা কি হাল ছেড়ে দেবেন? বসে বসে কি সুকান্ত বাবুর মায়ের বিয়োগে লেখা এই শোকার্ত কবিতা আওড়াবেন?
‘হে পৃথিবী আজকে বিদায়
এ দুর্ভাগা চায় বিস্মৃত শৈশবে
যে আধার ছিল চারিদিকে
তারে কি নিভৃতে আবার আপন করে পাবো।’
যাদের এখনো বয়স আছে চাকরিতে আবেদনের। তারা হয়তো আত্মতৃপ্তি অনুভব করছেন। কিন্তু সময় কিভাবে যাবে আপনি বুঝতেই পারবেন না। যদি তিরিশের মধ্যে আপনার চাকরি হয়ে যায় তাহলে তো আপনি একজন ভাগ্যবান বটে। কিন্তু যদি কোন কারণে ক্যাচ দিয়ে ফেলেন তখন আপনার আফসোসের শেষ থাকবে না।
সুতরাং এখন ৩৫ এর দাবীতে গড়ে উঠা আন্দোলনে আপনার শারীরিক ও নৈতিক সমর্থন দেওয়া উচিত মনে করি। এতে আপনার ক্ষতি হবে না বরং আপনিও হয়তো কোন কারণে লাভবান হতে পারেন। আজ এ আন্দোলনে অনেকেই যুক্ত যারা ৩৫ এর দাবিতে আন্দোলন করবেন হয়তো কখনোই ভাবেননি। তারা ছিলেন তিরিশ বছর বয়সের মধ্যে চাকরি পাবার খোয়াবে বিভোর।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ২৬-২৭ বছর বয়সে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করে ৩০ এর মধ্যে চাকরির পড়াশোনা করে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া বড়ই দুষ্কর। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আজ
‘দাবি আদায়ে হয়ে উঠো সোচ্চার,
বেজে উঠলো কি সময়ের ঘড়ি
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি
আমরা সবাই যে প্রহরী
উঠুক ডাক- উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে
জ¦লুক আগুন গরিবের হাতে
ভীরুরা থাক কোটি কড়াঘাতে পৌঁছাক দ্বারে
মানবো না বাধা, মানবো না ক্ষতি
চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি।’
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক বাংলাদেশের নাগরিকের জন্য ১৮টি মৌলিক অধিকার রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’ অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বাংলাদেশী স্বতঃসিদ্ধভাবে কতিপয় মৌলিক অধিকারের মালিক। তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’র শুরুতেই ২৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে।
এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী পূর্বেকার সকল আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। মৌলিক অধিকার শারীরিক ও মানসিক সীমানা সংকোচনকারী কৃত্রিম বাধা অতিক্রম করে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ নিশ্চিত করে নাগরিকদের জীবন মর্যাদাপূর্ণ করে।
সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার দিয়েছে। সুতরাং বলা যায় ৩৫ দাবি যৌক্তিক। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন করে বয়সসীমা তিরিশ করে রাখা হয়েছে। কোনো কারণে আন্দোলন করে ব্যর্থ হলে আন্দোলনকারীরা মৌলিক অধিকার বলবদের দাবিতে আদালতে রিট করে অধিকার আদায় করে নিতে পারেন। ৩৫ দয়া অনুকম্পা বা করুণা নয় এটা তারুণ্যের ন্যায্য অধিকার।
‘অধিকার কেউ কাউকে দেয় না , নিজের অধিকার নিজেকে আদায় করে নিতে হয়’- মাওলানা ভাসানী
[লেখক: শিক্ষক ও গবেষক]