ট্রমায় ভুগছেন আন্দোলনে নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা, আছে শঙ্কাও

আন্দোলন থেকে এক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে
আন্দোলন থেকে এক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে  © সংগৃহীত

কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার তুমুল গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরাচারী তকমা পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশে ছেড়ে চলে যাওয়ার মাস পেরিয়েছে। তবে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে গ্রেফতার হওয়া শিক্ষার্থীরা নির্যাতনের দুর্বিষহ স্মৃতি থেকে এখনও বের হয়ে আসতে পারেনি। থানা-হাজত, জিজ্ঞাসাবাদ, রিমান্ডে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের দুর্বিষহ স্মৃতি এখনও তাদের তাড়া করে ফিরছে। যা সৃষ্টি করেছে মনস্তাত্বিক ট্রমা। ফলে ব্যাহত হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক ও শিক্ষাজীবন। অনেকের মধ্যে এসেছে আচরণগত পরিবর্তনও।

বৈষম্যের প্রতিবাদ করে গ্রেফতার হওয়া শিক্ষার্থীরা বলছেন, থানা হাজতে অকথ্য গালিগালাজ, রিমান্ডে নির্যাতন, তথ্য বের করে নিতে দেয়া নানা হুমকি তাদের আজও তাড়া করে ফিরছে। তাই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। ঠিকভাবে মিশতে পাড়ছেন অন্যান্যদের সঙ্গে। আর যে পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন তারাও নিজ নিজ পদে বহাল আছেন। যা আরও শঙ্কা বাড়াচ্ছে ট্রমায় ভোগা শিক্ষার্থীদের।

আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত জুলাই ও আগস্ট মাসে রাজধানীর যে কয়েকটি স্থানে পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নীলক্ষেত ও নিউমার্কেট এলাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসেফিক, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ওই এলাকায় আন্দোলন করেন। সম্প্রতি তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের। 

তবে শঙ্কিত শিক্ষার্থীরা তাদের নাম, পরিচয় প্রকাশের সম্মতি দেননি এই প্রতিবেদককে। নিউমার্কেট এলাকা থেকে গত ১৭ জুলাই গ্রেফতার হয়েছিলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগের এক ছাত্রসহ বেশ কয়েকজন। ‘আ’ অদ্যাক্ষরের নামের ওই ছাত্র দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গত ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা হলে আমরা শিক্ষার্থীদের সাহায্যে যাই। সেখানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ঘেরাও করে ছিল। মাগরিবের পর পর পুলিশ ধাওয়া দেয়া শুরু করে। পরে আমাদের ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। ১৭ জুলাই পুরো রাত আমাদের নিউমার্কেট থানার হাজতে রাখা হয়। সেখানে চলে অকথ্য নির্যাতন।

‘থানাহাজতেই চলে নানা পদ্ধতিতে শারীরিক নির্যাতন। কারো কারো আঙ্গুলে সুঁই ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কাউকে কাউকে পেটানো হয়। গালাগালি ছাড়া কোনো কথাই বলা হয়নি। সেখানে আমার এক বন্ধুকে এক পুলিশ কর্মকর্তা এত জোড়ে থাপ্পড় মারেন যে সে যতদিন জেলে ছিল ডান চোখ ঠিকমতো খুলতে পারেননি। পুলিশ নানাভাবে আমাদের ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। তাদের কেউ কেউ বলেন, আপনাদের পরিবারের তথ্য আছে, তাদেরও তুলে আনা হবে। এক পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, তোরা কোটা চো..স? তোদের পু...কি দিয়ে ভরে দেব কোটা।’ 

তিনি বলেন, থানাহাজতেই চলে নানা পদ্ধতিতে শারীরিক নির্যাতন। কারো কারো আঙ্গুলে সুঁই ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কাউকে কাউকে পেটানো হয়। গালাগালি ছাড়া কোনো কথাই বলা হয়নি। সেখানে আমার এক বন্ধুকে এক পুলিশ কর্মকর্তা এত জোড়ে থাপ্পড় মারেন যে সে যতদিন জেলে ছিল ডান চোখ ঠিকমতো খুলতে পারেননি। পুলিশ নানাভাবে আমাদের ভয়ভীতি দেখাতে থাকে। তাদের কেউ কেউ বলেন, আপনাদের পরিবারের তথ্য আছে, তাদেরও তুলে আনা হবে। এক পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, তোরা কোটা চো..স? তোদের পু...কি দিয়ে ভরে দেব কোটা। 

আরও পড়ুন : পুলিশ দুঃখিত, সব হত্যাকাণ্ডের তদন্ত হবে: নতুন আইজিপি

তিনি জানান, ১৮ জুলাই আমাদের আদালতে তুলে ৫ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। সেটি বাতিল হয়। পরে ফের রিমান্ডের আবেদন করে পুলিশ। তখন তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। রিমান্ডে আমাদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের দুইজন ছাত্র ছিল। রিমান্ডে চলতো নির্যাতন। একজন একজন করে নিয়ে যাওয়া হত রিমান্ডে। একজনের কোমরের হাড় ভেঙে যায়। এমনকি ওই শিক্ষার্থীর এক্সরে রিপোর্টও কোর্টে জমা দেয়া হয়নি। তিনি দাবি করেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের স্বজনদের ক্ষতিসাধনের হুমকিও দেন। আমার আঙ্গুলে সুঁই ফুটিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কেন নির্যাতন চলছে তা জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন, তারা জানান, প্রমোশন বা ভালো পোস্টিংয়ের আশায় এমনটি করেছেন।

‘আমরা এখনো চিন্তিত কী হতে কী হয়। তাই নাম প্রকাশ বা ভিডিও সাক্ষাৎকার দিতে চাই না। আমাদের ওই স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে। আমাদের ভয় কখনও যদি সেই আবার ফিরে আসে আমাদের কী হবে? আমরা যারা গ্রেফতার হয়েছি তাদের তথ্য আছে পুলিশের কাছে। আর আগের পুলিশ কর্মকর্তারাই এখনও বহাল আছেন।’ 

তিনি বলেন, আমরা এখনো চিন্তিত কী হতে কী হয়। তাই নাম প্রকাশ বা ভিডিও সাক্ষাৎকার দিতে চাই না। আমাদের ওই স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে। আমাদের ভয় কখনও যদি সেই আবার ফিরে আসে আমাদের কী হবে? আমরা যারা গ্রেফতার হয়েছি তাদের তথ্য আছে পুলিশের কাছে। আর আগের পুলিশ কর্মকর্তারাই এখনও বহাল আছেন। 

নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা বলছেন, সেই দুর্বিষহ স্মৃতি তাদের তাড়া করে ফিরছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হলেও যে কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন, তারা থানাগুলোতে বহালই আছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতার শীর্ষ থেকে হঠাৎ পতিতরা ক্ষমতা ফিরে পেতে নানা ষড়যন্ত্র করছেন। তাই গ্রেফতার হওয়া  শিক্ষার্থীরা শঙ্কায় আছেন।  

আরও পড়ুন : কারাগারে থাকা ৪১ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর জামিন

গ্রেফতার নির্যাতিত শিক্ষার্থীদের আচরণগত পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করছেন তাদের সহপাঠীরা। তাদের মতে, গ্রেফতার শিক্ষার্থীদের কারো কারো মধ্যে অন্যমনস্কতা, হুট করে রেগে যাওয়া ও মনোযোগ হারানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা এসব কারণে ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে শুধু আন্দোলনে গ্রেফতার নন, যারা চোখের সামনে অন্যান্যদের ওপর গুলি-নির্যাতন প্রত্যক্ষ করেছেন বা স্বজন হারিয়েছেন তারাও ট্রমায় ভুগছেন। 

এদিকে আন্দোলনের পর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করছে বলে জানিয়েছেন নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস চালুর পর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।

ট্রমায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিংয়ের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যে শিক্ষার্থীরা ট্রমায় আক্রান্ত তাদের মানসিক রোগের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কাউন্সেলিং করা যেতে পারে। সংগঠন, সরকার, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগে তাদের কাউন্সেলিং করানো যায়। আর এ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি তাদের পরিবার, বন্ধু-সহপাঠীদের সাপোর্টটা গুরুত্বপূর্ণ। 

গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ‘স্বৈরাচারের আস্থাভাজন’ হিসেবে আখ্যা পাওয়া পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বিপাকে পরেন। পুলিশের শীর্ষপদের কর্মকর্তারা লাপাত্তা হয়ে যান, পালাতে শুরু করেন অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তারাও। বেশ কয়েকটি থানা পুড়িয়ে দেয়া হয়। দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে গত ৭ আগস্ট সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে মো. ময়নুল ইসলামকে নতুন আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

শিক্ষার্থীদের ট্রমা ও শঙ্কা সম্পর্কে জানতে মন্তব্য জানতে আইজিপি মো. ময়নুল ইসলামের সঙ্গে বারবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। তবে দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ৮ আগস্ট দুপুরে পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি পুলিশের ব্যর্থতা শিকার করে নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, বর্তমান বৈষম্যবিরোধী যৌক্তিক আন্দোলনে আমাদের পূর্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দেশবাসীর প্রত্যাশা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। এ জন্য বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে আমি পুলিশ প্রধান হিসেবে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমরা এখন থেকে আমাদের ওপর অর্পিত সব আইনি দায়িত্ব পালনে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। পুলিশের আইজিপি হিসেবে আমাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সবার আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করছি। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতি ফিরিয়ে আনতে আমরা সর্বাত্মকভাবে সচেষ্ট রয়েছি। 

ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর জন্য পুলিশের কিছু কর্মকর্তা দায়ী বলে মন্তব্য করে আইজিপি ময়নুল ইসলাম বলেন, আমাদের কতিপয় উচ্চাভিলাসী, অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে এবং কর্মকৌশল প্রণয়নে বলপ্রয়োগের স্বীকৃত নীতিমালা অনুসরণ না করায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতায় আমাদের অনেক সহকর্মী আহত, নিহত ও নিগৃহীত হয়েছেন। আমাদের ত্রুটি–বিচ্যুতি হয়েছে। সেগুলোর ক্ষেত্রে যারা এমন করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রবিধানসহ অন্য যেসব আইন ও চাকরিবিধি রয়েছে, সেগুলোর আলোকে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।


সর্বশেষ সংবাদ