রিভিউ: কী আছে হাওয়া সিনেমায়?

হলে হাওয়া সিনেমার প্রদর্শনী
হলে হাওয়া সিনেমার প্রদর্শনী  © টিডিসি ফটো

হাওয়া। উত্তাল সমুদ্রে চিত্রায়িত সিনেমা। নামেও আছে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক। হাওয়া সিনেমার একটি গান প্রকাশিত হতেই এই  সিনেমার জয়জয়কার। এ বছর ঢালিউডে যতগুলো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে সে সবগুলো মিলিয়ে যত আগ্রহ ছিলো দর্শকদের মনে তার ছেয়ে বেশি আগ্রহ তৈরী হয়েছে এই সিনেমা নিয়ে। তাইতো মুক্তির আগেই শেষ হয়ে যায় হলের টিকিট। 

আজ শুক্রবা মুক্তির প্রথম দিন থেকেই রেকর্ড পরিমাণ শো নিয়ে শুরু হয়েছে ‘হাওয়া’র যাত্রা। দেশের সবচেয়ে বড় মাল্টিপ্লেক্স চেইন স্টার সিনেপ্লেক্সের পাঁচটি শাখায় প্রতিদিন সর্বাধিক ২৬টি প্রদর্শনী চলবে।

অলৌকিক সমীকরণে নয়, বরং গল্প, নির্মাণশৈলি আর অভিনয়ের জাদু দিয়েই ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়েছিলো এই সিনেমা। আজ মুক্তির  মাধ্যমে সেই পূর্বাভাস বাস্তবে রূপ নিয়েছে। হাওয়ার তোড়ে ঝড় উঠেছে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে। এই ‘হাওয়া’ কতদিন দর্শকদের ভাসিয়ে রাখে সেটাই এখন দেখার বিষয়। 

কি আছে হাওয়া সিনেমাতে? কেন নির্মাতা, অভিনেতা, দর্শকদের আগ্রহের তুঙ্গে এই সিনেমা? সেটি এখন জানানোর চেস্টা করবো। 

সমুদ্রের মধ্যে নানা বিপদ মাথায় নিয়ে টানা ৪০ দিনের শুটিং হয় এই সিনেমার। একটা নৌকা নিয়ে একদল জেলে সাগরের বুকে মাছ ধরতে চলল। অনেক আনন্দ। জলের ঢেউয়ে এগিয়ে চলেছে নৌকা। ঢেউ আছড়ে পড়ছে নৌকার গায়ে। দেখতে বেশ ভালোই লাগে। জাল পেলল সমুদ্রে। প্রথমবার কিছু মাছ উঠলেও দ্বিতীয়বারে জালে উঠলো এক মেয়ে। অন্য সব নৌকায়  অনেক মাছ ধরা পড়ছে কিন্তু এ নৌকায় কেন ধরা পড়ছে না! তবে কী মাছেরা এ নৌকায় সাথে আড়ি পেতেছে নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? 

আরও পড়ুন: টিকেট না পেয়ে সিঁড়িতে বসে ‘হাওয়া’ দেখলেন নায়িকা!

নৌকার মধ্যে একটা নতুন হাওয়া লেগেছে। কিসের হাওয়া? একেবারে দুই রকমের হাওয়া। এক সামুদ্রিক হাওয়া দুই রহস্যের হাওয়া। একটা রহস্য শুরু হয়েছে। এর কিনারা কোথায়? কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে কেউ বুঝতে পাচ্ছে না। একবার এই বিপদ তো আরেকবার অন্য বিপদ কিন্তু বিপদের কান্ডারি কে? নৌকার মালিকের মাথা গরম। একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে এবার। কিন্তু তাতে কি শাপে বর হবে নাকি শিরে সংক্রান্তি! 

সমুদ্রের জল জোয়ার-ভাটায় আচরণ করে থাকে। ভাটার পর জোয়ারের উত্তাল হাওয়া শুরু হলে যেমন ভয়ের কারণ থাকে নৌকার  ভেতরেও ভয়ের পরিবেশ আসতে থাকে। একটার পর একটা বদ হাওয়া, যা নৌকার মালিকের ভাষায় ‘কালা জাদু’।  এমনভাবে দৃশ্যয়ান করা হয়েছে মনে হবে দর্শক ও ভয় পাচ্ছে।

ছবিতে গালি দেয় সবাই। তবে আপত্তিকর কিছু নেই। চরিত্রের প্রয়োজনে এসব ভাষা ব্যবহার করতে হয়েছে। ছবির শেষে ক্লাইম্যাক্স ছিলো। এ তো অলৌকিক হাওয়া। যা আপনার মাথায়ই আসবে না। কিভাবে সেই ঘটনা ঘটে গেল! যে হাস্যরসে ছবির অর্ধেকটাই মেতে থাকবে দর্শক শেষে এসে আচমকা ধাক্কায় নীরব করে দেবে। সিনেমার বাঁক তো এমনই হবার কথা। 

সিনেমার প্রথম অংশে কমেডি ছিলো খুব। হলের দর্শকরা সবাই হেসেছে এবং চরিত্রগুলোকে চিনানো হয়েছে। দ্বিতীয় অংশে সাসপেন্সের সাথে আবেগও ছিলো। দর্শক আৎকে উঠেছে, ভয় পেয়েছে, কষ্ট লেগেছে, চোখ ছলছল করছে। হয়তো মনের অজান্তে চোখের কোণে হাত রেখেছেন অনেকেই। একটা মানুষকে দুই ঘন্টার মধ্যে এতগুলা জার্নিতে নিয়ে যাওয়া সিনেমা সফল বলেই মনে হয়।

ছবির পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনের প্রথম সিনেমা । কিন্তু দেখলে মনে হবে অত্যন্ত পরিপক্ক হাতে একটা একটা সুতা দিয়ে হাওয়া নামের কাপড় তৈরী হইছে। যেটা দেখতে সাধারণ মনে হলেও ডিটেইলস চোখে পড়তে বাধ্য। এক কথায় অনবদ্য নির্মাণ। 

এবার আসি অভিনেতাদের কথায়। চঞ্চল চৌধুরী নিজের জাত চেনানোর সুযোগ কখনই ছাড়েন না। এবারও নৌকার মালিক চরিত্রে নিজেকে ছাপিয়ে গেসেন। জেলে নৌকার মেকানিক চরিত্রে স্বাবলিল অভিনয় করেছেন শরিফুল রাজ। প্রথম দেখায় চেনাই যায়না। একটা ময়লা হাফপ্যান্ট আর ফুটাফুটা স্যান্ডো গেঞ্জিতে পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে হাজির হয় শরিফুল রাজ।

নাজিফা তুষিও নিজের সেরাটা দেয়ার চেস্টা করেছেন। তার চোখ,চাহনী ভালো লাগবে, ভালো লাগতে লাগতে ভয় লাগবে। গুলতি নামের একটাই নারী চরিত্র আর তার পুরোটাই রহস্য ঘেরা। কিন্তু শেষে এসে চেয়ার থেকে পিঠ উটিয়ে ফেলার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা তিনিই দিবেন।

নাসির উদ্দিন মজার একটা ক্যারেকটার। মানুষ তাকে বাংলাদেশের নওয়াজ উদ্দিন বলতে শুনলাম। অভিনয় দেখে মনে হলো ভুল বলেননি। উর্কিস-পার্কিস এই চরিত্রের দুইজনই বেশ আনন্দ দিয়েছে আবার কষ্টও দিয়েছে। 

ক্যামেরা! সূর্যরশ্মির সাথে সমুদ্রের জলের ওঠানামার তরঙ্গ, জোছনা রাতে সমুদ্রের কাব্যিকতা, জলের ভেতর তিমির অবগাহন সব খেলে বেড়াচ্ছে ছবি জুড়ে। আহা! যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। সিনেমার লাইট, কালার ছিল অনবদ্য, ভালো। একটা নৌকায় পুরো সিনেমা শেষ কিন্তু নৌকাটার সব পরিবেশের আবহ ছিল অন পয়েন্টে। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরগুলোও ভালো লাগছে। পুরা সিনেমায় গান একটাই সেটাও ‘সাদা সাদা কালা কালা।’

সবমিলিয়ে ‘হাওয়া’কে বাংলা সিনেমার এক মাস্টারপিস বলা যায়। হলে গিয়ে দেখার মত একটা সিনেমা। সিনেমা শেষে বাসে করে বাসায় ফিরছি। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। চোখ বন্ধ করলে মনে হচ্ছে মাঝ সমুদ্রে আছি.. হয়তো চোখ খুললে দেখবো বিশাল এক সুরমা মাছ (সিনেমা দেখলে বুঝবেন কেন এই মাছের কথা বললাম)। সুরমা মাছের রহস্য উন্মোচর করতে হলে গিয়ে দেখুন ‘হাওয়া’। 


সর্বশেষ সংবাদ