টুয়েলভথ ফেল
খারাপ পরিস্থিতি কখনোই স্বপ্ন জয়ে বাধা হতে পারে না
- সাদিয়া তানজিলা সানভী
- প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৫১ PM , আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:১০ PM
মাঝে মাঝে কিছু গল্প আমাদের আবারও জীবনকে নিয়ে ভাবতে শেখায়, মনের কোণায় নিভু নিভু মনোবল আর ইচ্ছেকে যেন প্রজ্বলিত করে তোলে। আমাদের প্রত্যেকের জীবনই একেকটা বিচিত্র গল্পের বই, যেখানে যেমন রয়েছে উত্থান তেমনি তার পেছনে রয়েছে কষ্টের পতনও। কিন্তু আমরা সকলেই যেন মাটিতে পড়তে চাইনা, চাই শুধু উড়তে। কিন্তু পড়তে না শিখলে কি উড়তে শেখা যায়? জীবনে কেউই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। সততা,পরিশ্রম ও কঠোর অধ্যবসায় দিয়ে সৌভাগ্যকে অর্জন করে নিতে হয়।
এমনি এক কঠোর সংগ্রামের গল্প নিয়ে তৈরি ‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমা। যা বর্তমান তরুণ সমাজের ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। নতুন বছরে এই সিনেমাটি তরুণ মনে আবারও ফিরিয়ে এনেছে উদ্দীপনা। হতাশা কাটিয়ে অনেকেই জীবনকে রিস্টার্ট দিয়ে শুরু করছেন নতুনভাবে। আইপিএস কর্মকর্তা মনোজ কুমার শর্মাকে নিয়ে ঔপন্যাসিক অনুরাগ পাঠকের উপন্যাস ‘টুয়েলভথ ফেল’ অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন বলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা বিধু বিনোদ চোপড়া।
সিনেমাটিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে একজন ১২ শ্রেণি ফেল করা ছাত্র চিটিং ছেড়ে নিজের সততা ও সংগ্রামের মাধ্যমে আইপিএস অফিসার হয়ে ওঠেন। তার এই সংগ্রামে তাকে প্রথম অনুপ্রেরণা দেন গ্রামের ডিএসপি।
সিনেমাটি আইপিএস অফিসার মনোজ কুমার শর্মা ও তার স্ত্রী আইআরএস অফিসার শ্রদ্ধা যোশীর বাস্তব জীবনের গল্প নিয়ে তৈরি। বিধু বিনোদ চোপড়া পরিচালিত ‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমাকে ‘থ্রি ইডিয়েটস’ এর পরে বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা সিনেমার আখ্যাও দিয়েছেন অনেকে।
সিনেমার গল্পের শুরুতে দেখানো হয় অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান মনোজের সরকারি কর্মকর্তা পিতা অসৎ কাজের প্রতিবাদ করায় তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। মনোজ এমন একটি গ্রামে বাস করে যে গ্রাম চুরি আর ডাকাতির জন্য বিখ্যাত। যেখানে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিজে দায়িত্ব নিয়ে নকল সরবরাহ করে ছাত্রদের পাশ করিয়ে থাকেন। কিন্তু গ্রামে একজন সৎ পুলিশ অফিসার আসায় সেবার আর মনোজদের স্কুলের কেউই পাশ করতে পারে না।
সংসারের হাল ধরতে মনোজ আর তার ভাই গ্রামের বাহিরে অটো চালানোর কাজ শুরু করলে গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের লোক বিনা অপরাধে তাদের গ্রেফতার করে। ডিএসপির জন্য তারা ছাড়া পেলে মনোজ তার সততায় মুগ্ধ হয়ে তাকে বলে ফেলে আমি আপনার মত হতে চাই। উত্তরে ডিএসপি বলেন, ‘তার জন্য তোমাকে চিটিং ছাড়তে হবে।’ যা মনোজের জীবনকে বদলে দেয়।
মুভিটিতে দেখানো হয় কীভাবে মনোজের দাদি তার জীবনের সবটুকু পুঁজি মনোজকে দিয়ে দেয় একজন সৎ পুলিশ অফিসার তৈরি হওয়ার জন্য। বিদায় বেলায় দাদি মনোজকে বলেছিল- ‘আবার গ্রামে এলে পুলিশের পোশাক পরেই আসিস।’
চোখ ভর্তি স্বপ্ন, কাঁধে দায়িত্ব আর দাদীর শেষ সম্বল নিয়ে মনোজ ডিএসপি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে শহরে এলে জানতে পারে সেবার সরকার পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে ভাগ্যের পরিহাসে বাসেই মনোজের সব অর্থ চুরি হয়ে যায়।
নিঃস্ব মনোজের জীবনে তখনি আশার আলো হয়ে আসে অপরিচিত এক শিক্ষার্থী পান্ডে। এরপর সে তার বন্ধু হয়। সেই থেকে শুরু হয় তার জীবনের সংগ্রাম। আইপিএস হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মনোজ আসে পান্ডের সাথে আরেক নতুন শহরে। নিজের থাকা খাওয়ার খরচ যোগাতে মনোজ কখনো সারাদিন আটার মিলে, কখনো লাইব্রেরিতে পরিষ্কার কর্মী হিসেবে বা কখনো বাথরুম পরিষ্কারের কাজ করে। সারাদিন এত সংগ্রামের পরও মনোজ যেন দিনশেষে তার স্বপ্নের পেছনে দৌড়াতে ক্লান্ত হয় না।
মনোজের জীবনকে সফলতার আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় গৌরী ভাইয়া। তার অবদান যেন আগুনকে জ্বলতে সাহায্য করা বারুদের মতো। গৌরি ভাইয়ের মতো চরিত্র মানুষকে মানবিকতা সম্পর্কে নতুন বার্তা দেয়। ‘মানুষ মানুষের জন্য’-এই অনুভব তৈরি করে। শুধু তাই নয়, অন্যের জয়েও যে নিজের আনন্দ হতে পারে, এর জন্য যে ত্যাগ করা যায় গৌরি ভাইয়া যেন তার অনন্য দৃষ্টান্ত।
এ সিনেমায় আরেক চরিত্র ‘শ্রদ্ধা’ মনোজের জীবনে এক অনুপ্রেরণার নাম। যে অনুপ্রেরণা মনোজকে বলেছিল-
"তুমি আইপিএস অফিসার হও,
অথবা আটার মিলে কাজ করো
আমি সারাজীবন তোমার সাথে থাকতে চাই।"
মনোজের সকল কঠিন সময় পার করতে শ্রদ্ধা যেন একজন প্রকৃত জীবনসঙ্গীর মতই তার পাশে থেকেছে। তাকে উৎসাহ যুগিয়েছে বন্ধুর মতো। মনোজ হাজার কষ্টের মাঝেও তার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। তাই জয়ী তো তাকে হতেই হতো। জীবনে অন্ধকার যত বেশি আলো যেন ততই সন্নিকটে। আর মনোজের মনে এই আশা বাঁচিয়ে রেখেছিল শ্রদ্ধা।
অপেক্ষা করেছে অন্ধকার কাটিয়ে একসাথে নতুন সূর্যোদয় দেখার। হয়তো সেজন্যই টুয়েলভথ ফেল মনোজ নিজেকে তৈরি করতে পেরেছে একজন আইপিএস অফিসার হিসেবে।
সিনেমাটি আমাদের বেশ কিছু বিষয়ে শিক্ষা দেয়
১. জীবনে মানুষ ব্যক্তির চেয়ে ব্যক্তির অবস্থানকে বেশি গুরুত্ব দেয়। ব্যক্তির গুরুত্ব বা মূল্যায়ন হয় সমাজে তার অবস্থান কেমন তার ওপর। সমাজে সকলের গুরুত্ব পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই আপনার অবস্থান শক্তভাবে তৈরি করতে হবে। আপনার লক্ষ্যে সফল হতে হবে। কারণ ক্ষমতা ও অর্থ থাকলেই মানুষ আপনাকে মূল্যায়ন করবে।
২. যারা আপনাকে সত্যিকারে ভালোবাসবে তারা কখনোই আপনার খারাপ সময়কে অজুহাত বানিয়ে ছেড়ে যাবে না। বরং আপনার সকল ভালো খারাপ পরিস্থিতিতে সে আপনার শক্তি হবে। আপনাকে উৎসাহ জোগাবে ঠিক শ্রদ্ধার মত।
৩.কথায় আছে জন্ম,মৃত্যু আর বিবাহ সৃষ্টিকর্তা আগে থেকেই নির্ধারণ করে সকলকে পৃথিবীতে পাঠান। কিন্তু পৃথিবীতে বন্ধু তৈরির গুরুভার কেবল ব্যক্তির একান্তই নিজের। একশ বন্ধুর চেয়ে একজন প্রকৃত বন্ধুর প্রয়োজন জীবনে অধিক। আমাদের সকলের বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। একজন ভালো বন্ধু আপনার সকল পরিস্থিতিতে আপনাকে ভালো উপদেশ দেবে। আপনার সকল খারাপ সময়ে আপনার পাশে দাঁড়াবে। নির্দ্বিধায় যার সাথে আপনি আপনার সকল দুঃখ কষ্ট শেয়ার করতে পারবেন। যে আপনার চোখের ভাষা দেখলেই মনের কথা বুঝবে। যে কখনোই আপনার সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হবেনা।
৪. উদ্দেশ্য সৎ থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব নয়। একটু দেরিতে হলেও সাফল্য আসবেই। জীবন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমাদের প্রত্যেকের উচিত আমাদের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। হতাশা কাটিয়ে আবার জীবনকে রিস্টার্ট দিয়ে শুরু করা।
৫. পরিস্থিতি কখনোই লক্ষ্যে বাধা হতে পারে না। ভাঙ্গা গড়া নিয়েই জীবন। জীবনে কেউই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় না। সততা,পরিশ্রম ও কঠোর অধ্যবসায় দিয়ে সৌভাগ্যকে অর্জন করে নিতে হয়। তাইতো বিল গেটস বলেছেন,
"আপনি যদি গরীব হয়ে জন্ম নেন
তাহলে এটা আপনার দোষ নয়,
কিন্তু যদি গরীব থেকেই মারা যান
তবে সেটা আপনার দোষ।"