কোষাধ্যক্ষ পদে অতিরিক্ত সচিব নিয়োগ, আইন বলছে বাধা নেই!
- ইরফান এইচ সায়েম
- প্রকাশ: ০৭ মে ২০২১, ০৩:১২ PM , আপডেট: ০৭ মে ২০২১, ০৮:৩১ PM
দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে সাধারণত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও প্রবীণ অধ্যাপকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাদেশ কিংবা আইনেও বিষয়টি উল্লেখ থাকে। তবে দেশের নবীনতম একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদে একজন সরকারি অবসরপ্রাপ্ত আমলা নিয়োগ দেওয়ায় বিস্ময় ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও তাদের সংগঠনসমূহ। যদিও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে শিক্ষকই হতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়টির আইনের এ ধরনের কোনো বিষয় উল্লেখ নেই বলে আইন ঘেঁটে দেখা গেছে।
যদিও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে শিক্ষা, গবেষণা ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রভূত অগ্রগতি হয়েছে এবং এখনো তা চলমান। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদগুলোতে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের মধ্যে থেকে নিয়োগ দেওয়া উচিত। কিন্তু বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোষাধ্যক্ষ পদে প্রশাসন ক্যাডারের পিআরএল ভোগরত (অবসর) একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়ায় আমরা বিস্মিত, মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য মতে, দেশের ৪৯টি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে একাডেমিক কার্যক্রম চলছে। এরমধ্যে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয় চারটি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম)। এছাড়া বাকিগুলো তাদের নিজস্ব আইনে পরিচালিত হয়। সরকার যখন এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন মনে করে তখন স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন তৈরি করে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করে। তারপর সেই আইন অনুযায়ী এসব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়।
২০১৭ সালের শুরুর দিকে জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলায় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয় সরকার। এটি বাংলাদেশের ৪০তম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ময়মনসিংহ বিভাগের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়টি আইন সংসদে পাশ হয়ে একই বছরের ২৮ নভেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
এদিকে, গত বৃহস্পতিবার (৬ মে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপ-সচিব মো. নুর-ই-আলম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কোষাধ্যক্ষ হিসেবে চার বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন মোহাম্মদ আবদুল মাননান। যিনি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল ভোগরত) ছিলেন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের অনুমতিক্রমে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১৭ এর ধারা ১৩(১) অনুযায়ী পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল ভোগরত) মোহাম্মদ আবদুল মাননানকে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কোষাধ্যক্ষ পদের বেতন-ভাতা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সুবিধাদি ভোগ করবেন। জনস্বার্থে এ আদেশ জারি করা হয়েছে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ঘেঁটে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির উপচার্য ও উপ-উপাচার্যের পদে নিয়োগে স্বনামধন্য শিক্ষাবিদদের নিয়োগের কথা থাকলেও কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে তেমনটা উল্লেখ নেই।
আইনের ১০নং ধারার ১নং উপ-ধারায় ভাইস-চ্যান্সেলর (উপাচার্য) নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, “চ্যান্সেলর, তৎকর্তৃক নির্ধারিত শর্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে স্বনামধন্য একজন শিক্ষাবিদকে ৪ বৎসর মেয়াদের জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ করিবেন: তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তি একাদিক্রমে বা অন্য কোনোভাবে ২ মেয়াদের বেশি সময় কালের জন্য ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।”
আর ১২নং ধারার ১নং উপ-ধারায় প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, “চ্যান্সেলর, প্রয়োজনবোধে, তৎকর্তৃক নির্ধারিত শর্তে ৪ বৎসর মেয়াদের জন্য ২ জন উপযুক্ত অধ্যাপককে প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ করিবেন যাহাদের মধ্যে একজন একাডেমিক কার্যক্রম এবং অপরজন প্রশাসনিক কার্যক্রম সম্পাদন করিবেন।”
অন্যদিকে, ১৩নং ধারার ১নং উপ-ধারায় কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, “চ্যান্সেলর, তৎকর্তৃক নির্ধারিত শর্তে ৪ বৎসর মেয়াদের জন্য একজন কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত করিবেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ভিসি ও প্রো-ভিসি নিয়োগে শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপকদের কথা বলা হলেও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দ্দিষ্ট কাওকে নিয়োগ দিতে হবে কিনা সেটি স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তাছাড়া আইনের ১৫ ধারায় রেজিস্ট্রার নিয়োগের বিষয়ে বলা হয়েছে, “রেজিস্ট্রার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কর্মচারী হইবেন এবং তিনি....”।
জানা গেছে, দেশের স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ও অপেক্ষকৃত পুরাতন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৩-৪ জনের একটি তালিকা চাওয়া হয়। ইউজিসির মাধ্যমে এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় হয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য যায়। এরপর রাষ্ট্রপতি যাকে নিয়োগ দেবেন পরবর্তীতে তিনিই এসব পদে দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি হয়ে থাকে। তবে নবীন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন তালিকা চাওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের অনুমতিক্রমে একজন অতিরিক্ত সচিবকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আপনারা (সাংবাদিকরা) যেভাবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংবাদটা পেয়েছেন আমি সেভাবে পেয়েছি। পরে উনি আমাকে ফোনে বিষয়টি জানালে আমি তাকে ‘অভিনন্দন জানায়।
তিনি আরও বলেন, কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে কোনো বিষয় উল্লেখ নেই। যেহেতু বিষয়টি মহামান্য রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত, সেক্ষেত্রে এখানে মন্তব্য করার কিছু নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ফেডারেশন ও কিছু শিক্ষক সমিতি এটাকে স্বায়ত্তশাসনের হস্তক্ষেপ মনে করছে। তারা কেন এটি মনে করছে সেটি আমার জানা নেই।
ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদ: বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন আজ শুক্রবার (৭ মে) এক বিবৃতিতে বলছে, প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন তার বিচক্ষণ নেতৃত্ব ও নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে একটি সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে গেছেন ঠিক তখন একটি মহল তার অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা ও তাদের অসাধু উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ ধরণের নিয়োগাদেশ প্রদানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অস্থিতিশীল করবার অপচেষ্ঠায় লিপ্ত। আমরা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে (অতিরিক্ত সচিব) বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগের আদেশ প্রদানের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই এবং অবিলম্বে এই নিয়োগাদেশ বাতিলপূর্বক প্রত্যাহার করবার জন্য সংশ্লিষ্ট কৃর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানায়।
নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান সৃষ্টির স্থান। একজন কোষাধ্যক্ষ ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে সমন্বয় পূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থসংশ্লিষ্ট বিষয়সহ জ্ঞান বিতরণ ও জ্ঞান সৃষ্টির নানাবিধ কর্মকাণ্ডে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করেন। কাজেই একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদই এই পদের যোগ্য। এই পদে একজন সরকারি কর্মকর্তার নিয়োগদান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর আমলাতন্ত্রের নগ্ন হস্তক্ষেপ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, আমাদের প্রত্যেকের পেশার জায়গাগুলোয় ভিন্নতা আছে এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চলে। স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে আমরা দেখে আসছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়ে আসছে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ পদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই নিয়োগ পেয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সরকারি কর্মকর্তারা তাদের জায়গায়, আমরা আমাদের জায়গায় কাজ করবো বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
কোন সঙ্গত কারণে সরকার সরকারি কর্মকর্তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা গণমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রচুর দুর্নীতির খবর পাচ্ছি। আমরা শিক্ষকরা যখন দুর্নীতি করি, তখন আমাদের মধ্যে বন্ডিং কাজ করে। আমরা এটা নিয়ে কোন কথা বলিনা, প্রতিবাদ করিনা। এমনকি বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতাও আমাদের মধ্যে আছে। সব চিন্তা করেই সরকার হয়তো নবীন এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একজন আমলা কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।