সম্পর্কের টানাপোড়েন: বুটেক্সে প্রকাশ্যে একে অপরকে মারধর, ঘুষি-থাপ্পড় দুই শিক্ষার্থীর

বুটেক্সে নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তা
বুটেক্সে নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তা  © টিডিসি

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক সহিংস ঘটনার রেশ এখনো কাটেনি। অভিযোগ, একই ব্যাচের এক ছাত্র প্রকাশ্যে এক নারী শিক্ষার্থীকে মারধর করেছে। সিসিটিভি ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য ও উভয় পক্ষের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ঘটনা শুধু একজনকে আঘাত করার নয়— এর পেছনে আছে পুরনো সম্পর্ক, ভুল বোঝাবুঝি এবং অনেক দিনের মানসিক চাপ।

ঘটনা ঘটে বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) দুপুরে। ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ফারিয়া রায়া এবং ইয়ার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র যায়েদ ইবনে জাফরের মধ্যে প্রথম বাকবিতণ্ডা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বিল্ডিংয়ের নিচে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, যায়েদ তখন রায়ার সঙ্গে জোরপূর্বক কথা বলার চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে রায়ার কানে আঘাত করে।

রায়া জানান, তর্কবিতর্কের এক পর্যায়ে সে আমার বন্ধুদের সামনে আমার গায়ে হাত তোলে। আমি পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে যাই।

ঘটনার সূত্রপাত সম্পর্কে জানা যায়, পূর্বে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ছিল, যা একসময় ভেঙে যায়। কিন্তু সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর রায়ার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে চলাফেরা ও ঘোরাফেরাকে কেন্দ্র করে যায়েদ বিরক্তি প্রকাশ করতেন। অভিযোগ রয়েছে, যায়েদ রায়ার ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে চলাফেরার ঘটনা তার বন্ধুদের মাঝেও বাড়িয়ে বলতেন এবং রায়ার নামে অপবাদ ছড়াতেন। বিষয়টি নিয়ে দুজনের মধ্যেই উত্তেজনা বাড়তে থাকে। রায়া কয়েকবার তার বন্ধুদের মাধ্যমে যায়েদকে সতর্ক করেন এবং একপর্যায়ে বিষয়টি দুই পরিবারের কাছেও পৌঁছায়। রায়ার ভাষ্য অনুযায়ী, বাধ্য হয়েই সে যায়েদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

ঘটনার আগের দিনগুলোতেও দুজনের মধ্যে ফোনে ঝগড়া ও বাকবিতণ্ডা চলছিল। সেই উত্তেজনার রেশ ধরেই মূল ঘটনার সূত্রপাত বলে উভয় পক্ষই আভাস দিয়েছেন। একাডেমিক বিল্ডিংয়ের নিচের ঘটনার পর রায়া ও তার কয়েকজন ব্যাচমেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। পরে তারা অভিযোগটি উপাচার্য বরাবর জানাতে রওনা হন। পথেই দ্বিতীয় দফায় প্রশাসনিক ভবনের সামনে, কেমিস্ট্রি ল্যাবের পাশে ফের দেখা হয় অভিযুক্ত যায়েদের সঙ্গে। সেখানে যায়েদ রায়ার দিকে ক্রুদ্ধভাবে তাকালে রায়া রাগে ক্ষোভে সহ্য করতে না পেরে তাকে থাপ্পড় দেন।

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, রায়া সেখানে যায়েদকে থাপ্পড় দিলে সে আক্রমণাত্মক হয়ে এলোপাতাড়ি ঘুষি-থাপ্পড় মারতে শুরু করে। তাকে থামাতে গেলে রায়ার সঙ্গে থাকা আরও দুই শিক্ষার্থী—আলহাজ্ব ও মিরাজ—আহত হন। রায়ার চোখের নিচে আঘাত লাগে ও নাক কেটে যায়। মেরাজের মুখে কেটে যায় এবং আলহাজ্বের শার্ট ছিঁড়ে যায়। পরে একপর্যায়ে আলহাজ্ব রাগে একটি কাঠ হাতে নিয়ে মারতে যায়, তবে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা তাকে থামিয়ে দেয়।

রায়া বলেন, ঘটনাটা এক দিনের না—দীর্ঘ দিনের হয়রানির ফল। সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরও যায়েদ বারবার আমাকে বিরক্ত করেছে, মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে, পরিবারে ফোন দিয়ে বিভিন্ন বাজে কথা বলেছে। ঘটনার দিন প্রথমে সে আমাকে জোর করে কথা বলাতে বাধ্য করে, পরে বন্ধুদের সামনেই থাপ্পড় মারে। আমি সহ্য করি। কিন্তু যখন দ্বিতীয়বার রাগান্বিত হয়ে তাকায়, তখন আমি নিজেকে রক্ষা করার জন্য ওকে থাপ্পড় দিই। এরপর সে আমাকে এলোপাতাড়ি মারে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ধরে নিলাম একসময় সম্পর্ক ছিল, তাই বলে কি সে আমার গায়ে হাত তুলবে? ক্যাম্পাসে নারীর নিরাপত্তা কোথায়? আমি বিচার চাই।

আহত শিক্ষার্থী আলহাজ্ব হোসেন বলেন, প্রথম ঘটনাটি স্টেশনারির সামনে ঘটে। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ দেখি এবং প্রক্টরকে জানাই। এরপর যখন ভিসিকে জানাতে যাচ্ছিলাম, তখন আবার মারধরের ঘটনা ঘটে। যায়েদ রায়াকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করে, আমাদেরকেও মারে। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সোয়াদ মেরাজ বলেন, যায়েদ আমার চোখ লক্ষ্য করে ঘুষি মারে। আমি সরে যাওয়ায় চোখ বেঁচে যায়, কিন্তু কেটে যায়। রায়া আমাকে আগেও জানিয়েছিল যায়েদ তাকে বিরক্ত করে। ফারিয়ার পরিবার জানায়, ঘটনার পর তার ভাই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

যায়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার মা জানান, যায়েদ অসুস্থ, মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে, ঘুমাচ্ছে, কথা বলতে পারবে না। তিনি বলেন, প্রায় এক বছর আগে রায়া জোর করে যায়েদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। পরে তার ব্যবহার খারাপ হওয়ায় যায়েদ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসে। এরপর রায়া তাদের পরিবারকে ফোন করে গালিগালাজ করে এবং হুমকি দেয়। তিনি আরও বলেন, রায়া নানা ছেলের মাধ্যমে যায়েদকে ভয় দেখায়, মানসিক নির্যাতন করে।

তবে যায়েদের পক্ষ থেকে এসব দাবির কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। অন্যদিকে রায়ার পক্ষ থেকে স্ক্রিনশট, মেসেজ ও কথোপকথনের বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে—যেগুলোতে দেখা যায় যায়েদ বারবার তাকে ‘পুরোনো সম্পর্ক’ ফিরিয়ে আনতে চাপ দিচ্ছে এবং না মানায় বিরক্ত করছে।

উল্লেখ্য, ঘটনার পর শুধু রায়া নয়, যায়েদও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল অফিসে লিখিত অভিযোগ জমা দেয়। তার অভিযোগ অনুযায়ী, চারজন শিক্ষার্থী লাঠি নিয়ে তাকে মারতে আসে। যদিও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, মারামারির সময় কারো হাতেই প্রথমে লাঠি ছিল না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ফারিয়া রায়ার অভিযোগ তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘Eve Teasing & Sexual Harassment Committee’ এর নিকট আবেদনটি প্রেরণ করা হয়েছে। একই দিনে ফারিয়া রায়ার বিরুদ্ধে যায়েদ ইবনে জাফরের দেওয়া অভিযোগও আমরা পেয়েছি, যা তদন্তের জন্য পৃথক একটি তদন্ত কমিটিতে পাঠানো হয়েছে।

এই ঘটনার পর অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—ক্যাম্পাসে নারীর নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত? সম্পর্কের ইতিহাস থাকলে কি তা একপক্ষকে সহিংসতা করার লাইসেন্স দেয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক যত জটিলই হোক, সেটার সমাধান শারীরিক সহিংসতা হতে পারে না। একজন নারী শিক্ষার্থীকে যদি একাডেমিক ভবনের নিচে বা প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রকাশ্যে হেনস্তা হয়, এবং সেটি সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে, তাহলে সেটিকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

এই ঘটনার মূল প্রশ্ন একটাই—একজন নারী শিক্ষার্থীর শরীরে আঘাত করার ‘কারণ’ হিসেবে কোনো সম্পর্ক, মান-অভিমান বা ব্যক্তিগত ইতিহাস কি বৈধতা পেতে পারে? বুটেক্স প্রশাসনের উচিত, দায়সারা প্রতিক্রিয়ার বাইরে এসে সিসিটিভি ফুটেজসহ প্রাপ্ত সব তথ্য বিশ্লেষণ করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া—যাতে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেউ আর এমন করার সাহস না পায়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence