ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে শাবিপ্রবির সাবেক শিক্ষার্থীর গবেষণা

  © টিডিসি ফটো

বর্তমানে সারাবিশ্বে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশবান্ধব নতুন নতুন জৈব পদ্ধতি উদ্ধাবনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় মশার ভেতরে ‘ওলবাকিয়া’ নামক জৈব প্রযুক্তি তথা ব্যাকটেরিয়া ঢুকিয়ে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে নতুন পদ্ধতি উদ্ধাবন করেছে বৈশ্বিক মশা গবেষকরা। বৈশ্বিক এ পরিবেশবান্ধব উদ্ধাবন যথাযথ ব্যবহারে বাংলাদেশেও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের একদল গবেষক। 

সম্প্রতি বাংলাদেশসহ ডেঙ্গু-ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ওলবাকিয়ার প্রয়াজনীয়তা নিয়ে ‘ইমপর্টেন্স অব ওলবাকিয়া মেডিয়েটেড বায়োকন্ট্রোল টু রিডিউস ডেঙ্গু ইন বাংলাদশ এ্যান্ড আদার ডেঙ্গু-এনডেমিক ডেভলপিং কান্ট্রিজ’ শিরোনামে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মেসবাহউর রহমানের নেতৃত্বে একদল গবেষক। 

মোহাম্মদ মেসবাহউর রহমান বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) জীবপরিসংখ্যান বিভাগ ও জনস্বাস্থ্য গবেষকের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এছাড়া গবষণাপত্রটি মূখ্য রচনায় গুরুত্বপূণ অবদান রেখেছেন বাংলাদেশের তরুণ জৈবপ্রযুক্তিবিদ আব্দুল্লাহ-আল নোমান। 

এ গবেষণাপত্রটি চায়না রোগ প্রতিরাধ সংস্থা ও চায়না মেডিকেল এসোসিয়েশন থেকে প্রকাশিত অন্যতম ‘জার্নাল বায়োসেফটি এন্ড হেলথ’ এ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘Science-X’ এর 'phys.org', ‘আমরিকান পাবলিক নিউজ টাইম’, ‘অপেরা নিউজ’ ও ইউকে'র বিজনেস-বিজ্ঞান বিষয়ক নিউজ-‘আলফা গ্যালিলিও’ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণা পরিচালনার বিষয়ে মোহাম্মদ মেসবাহউর রহমান বলেন, মশার প্রজনন কমাতে যেসব জায়গাতে মশা জন্মায় সেখানে কীটনাশক ও ধোঁয়া প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় মশা সামান্য পরিমাণে কমলেও, পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ে। এমনকি কীটনাশক ও ধোঁয়া প্রয়োগ করার পরও মশা স্বাভাবিক গতিতে বাড়ার সাথে সাথে মশাবাহিত রোগের বিস্তার ঘটায়। এর ধারাবাহিকতায় বিগত কয়েকবছর ধরে রেকর্ড সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশসহ ডেঙ্গু-ঝুঁকিতে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ডেঙ্গু কিভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তা বৈশ্বিকভাব প্রয়াজনীয়তা দেখা দেয়। এজন্যই বৈশ্বিক জৈব প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব ‘ওলবাকিয়া’ পদ্ধতির প্রয়োগ বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে কেমন সহায়ক হবে তা নিয়ে এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। 

গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল সম্পর্কে এ গবেষক বলেন, প্রাকৃতিকভাবেই কীটপতঙ্গে জন্মায় এবং অবলিগেটরি সিমবায়োন্ট অর্থ্যাৎ পরিবেশে সুনির্দিষ্ট হোস্ট বা বাহক ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। এটি মশার কীটনাশকের প্রতি সংবেদনশীলতাকে প্রভাবিত করে না। এমনকি প্রাকৃতিকভাবে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে ছড়ায় না। ওলবাকিয়া-কট্রােল পদ্ধতিটি বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্রাস করবে বলে একটি গবেষণায় অনুমান করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার একটি গবেষণায় দেখানাে হয়েছে যে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান ওলবাকিয়া প্রকল্প, মশাবাহিত প্রায় ৩৮ শতাংশ স্বাস্থ্য ব্যয় হ্রাস করতে পারে। তদুপরি, যেহেতু এই ব্যাক্টেরিয়া বেশ কয়েক বছর ধরে অব্যাহত থাকতে পারে, তাই ভ্যাকসিন কভারেজ বা ভেক্টর নিয়ন্ত্রণের কৌশলগুলোর মতাে অতিরিক্ত চলমান ব্যয়ের প্রয়াজনীয়তা কমে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। যদিও, নতুন পদ্ধতি হিসেবে এটির প্রাথমিক খরচ একটি অভিনব হিসেবে যথেষ্ট বেশি, ‘ওয়ার্ল্ড মসকিটাে প্রােগ্রাম’ এই পদ্ধতি প্রবর্তনে কাজ করছে। বর্তমানে ওলবাকিয়া-সংক্রমিত মশার প্রজনন করে এর ডিম বিভিন্ন দেশ যেমন শ্রীলঙ্কা, ভানুয়াতুতে প্রদান করছে। কাজেই সরকারের উদ্যাগ এবং ওয়ার্ল্ড মসকিউটাে প্রােগ্রামের সহায়তায় এই কার্যকরী পদ্ধতিটি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

‘ওলবাকিয়া’ পদ্ধতি প্রয়াগে বাংলাদেশে পরিবেশের উপর কােন বিরুপ প্রভাব বিস্তার করার সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে এ গবেষক বলেন, মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে উন্নত বিশ্বের দেশগুলাে বায়ােলজিকাল কট্রােল সম্প্রতি সময় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে পরিবেশ বান্ধব হওয়ার কারণে। কীটনাশক ও ধোঁয়া প্রয়ােগে পরিবেশ ও অন্যান্য জীববৈচিত্র ক্ষতি করে। তবে এ জৈব প্রযুক্তি ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া ৪০-৬০% আর্থােপেড প্রজাতিতে প্রাকৃতিকভাব জন্মায়, যদিও এডিস প্রজাতিতে পাওয়া যায় না। এটি মূলত মশার মিলনের মাধ্যমে ছড়ায় এবং পুরুষের শুক্রাণুর পরিবর্তনসহ বিভিন প্রজননগত ত্রুটির সৃষ্টি করে যা ডেঙ্গু বিস্তারে বাঁধা দেয়। ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিলসহ বেশ কয়েকটি দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের গবেষণা বলছে, এই পদ্ধতিতে ৮০% এর ও বেশি ডেঙ্গু সংক্রমণ কমানাে সম্ভব। এখন পর্যন্ত শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রাজিল সহ ১৩টি দেশে এই পদ্ধতির ক্লিনিকাল ট্রায়াল চলছে।

‘বাংলাদেশেও এই পদ্ধতির প্রয়ােগে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পাইলট স্টাডির মাধ্যমে ফিজিবিলিটি পর্যবেক্ষণ করে, টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতি হিসেবে, ওলবাকিয়া বায়াে-কন্ট্রোল ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে। এক্ষেত্রে ‘ওয়ার্ল্ড মসকিটাে প্রােগ্রাম’ এর সহায়তা নিয়ে, সমন্বিত প্রচেষ্টায় কাজ করতে পারলে ডেঙ্গু সংক্রামণ মােকাবেলা বেশি ফলপ্রসূ হতে পারে। তাছাড়া, গবেষনার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে উন্নত মলিকুলার বায়ােলজি ল্যাব, দক্ষ জনশক্তি এবং সর্বােপরি জাতীয় উদ্যােগ ও কর্মপরিকল্পনা অতীব জরুরী’ বলে জানান এ গবেষক। 

বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলাতে এ পদ্ধতি প্রয়ােগের প্রস্তাব দিয়েছে এ গবষক দল। গবষকরা জানান, দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রাণালয় নিরলসভাবে ডেঙ্গু নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে দেখা গেছে, জুলাই ও আগস্ট মাসে ডেঙ্গু সংক্রামণ বাড়ে, এমনকি বিগত কয়েক বছরের হিসাবে প্রতিবছর মত্যুহার পূর্বের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, অসময়ে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও দীর্ঘ সময় থেমে-থেমে বৃষ্টিপাত এবং যথাসময়ে বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্বের গুরুত্ব অনুধাবন না করা, ফলপ্রসূ না হওয়া, মশার কীটনাশক প্রতিরােধী হওয়া, সাধারণ মানুষের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতার অভাব, পর্যাপ্ত গবেষণার ঘাটতি, এবং কর্মপরিকল্পনা ও সমন্বয়হীনতার অভাবে এডিস মশা বংশবিস্তার ও ডেঙ্গু সংক্রামণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য ও কিটতত্ববিদগণ। এজন্য বৈশ্বিক এ পরিবেশবান্ধব উদ্ধাবন ‘ওলবাকিয়া’ যথাযথ ব্যবহার বাংলাদেশেও মশাবাহিত রােগ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভুমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন গবেষক দলটি।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence