স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি ঘোষণা করার এখতিয়ার আছে ইউজিসির?

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।  © লোগো

সরকারি চাকরিতে প্রবেশে কোটা প্রথার বাতিল চেয়ে চলমান কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের নিহত এবং আহত হওয়ার ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। দেশের উচ্চশিক্ষা এ তদারক সংস্থার পক্ষ থেকে কারণ হিসেবে—শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি জানানো হয়েছে। একই সাথে শিক্ষার্থীদের থাকার আবাসিক হলগুলোও বন্ধের নির্দেশনা জানানো হয়েছে কমিশনের একই নির্দেশনায়।

ইউজিসির নির্দেশনায় বলা হয়েছে—শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় দেশের সকল পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত মেডিকেল, টেক্সটাইল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও অন্যান্য কলেজসহ সকল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। একই সাথে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আবাসিক হল ত্যাগের নির্দেশনা দিয়ে নিরাপদ আবাসস্থলে অবস্থানের নির্দেশনা প্রদান করা হলো।

এমন নির্দেশনার পর স্বায়ত্বশাসিত বা নিজস্ব আইনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন তুলছেন ইউজিসির এমন নির্দেশনা নিয়ে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত হচ্ছে। সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন থাকা এ উচ্চশিক্ষালয়গুলোর শিক্ষকরাও প্রশ্ন তুলছেন কমিশনের এমন নির্দেশনায়। 

আরও পড়ুন: সব সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা ইউজিসির

ইউজিসি কার্যাবলিতে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি বা অভ্যন্তরীণ কোনো সিদ্ধান্তের এখতিয়ার রাখা হয়নি। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটকে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করতে হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে—বলছেন শিক্ষকরা।

মঙ্গলবার রাতে ইউজিসির নির্দেশনার আগে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি)। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয় জরুরি একটি সিন্ডিকেট সভা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর আগে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে আন্দোলনরত এক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে নিহত হলে রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে আগুন এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ফলে এমন জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।

ইউজিসির এমন সিদ্ধান্তে প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার কে, এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ৭৩ এর অধ্যাদেশ কি নাই হয়ে গেছে? ইউজিসি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে পারে? জীবনে কখনো শুনিনি। এমনতো কক্ষনো হয়নি। 

আরও পড়ুন: কোটা আন্দোলনের সংঘর্ষে আরেকজনের মৃত্যু, নিহত বেড়ে ৭

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালের বিশেষ আইনে পরিচালিত হয়। এই আইনে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও খোলার ক্ষসতা একমাত্র সিন্ডিকেটে। সিন্ডিকেট সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেউ বিরোধিতা করলেও হবে না।

সেখানে ইউজিসি একটি চিঠি দিয়ে বন্ধ করে দিল প্রশ্ন রেখে প্রবীণ এ শিক্ষক বলেন, ইউজিসি কোনোভাবেই চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে পারে না। এমনকি সরকারও পারে না। ইউজিসি বা সরকার চারটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করতে হলে আগে ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট বাতিল করে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ সরকারকে নিতে হবে। 

অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, বিশেষ কোন ইমারজেন্সি (জরুরি) হলে সরকার ভাইস চ্যালেন্সরকে রিকুয়েস্ট (অনুরোধ) করতে পারে—জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য। সেটা ওনি শুনবেন কি শুনবে না—তার এখতিয়ার। সেটা শুনলেও উপাচার্য তার ক্ষমতাবলে মাত্র চারদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে পারে। এরপর সিন্ডিকেট ডেকে সেটা অনুমোদন নিতে হবে। না হয়, উপাচার্য শাস্তির মুখে পড়বেন। ইউজিসি সব জেনেও এটা কেন করেছে তারা ভালো বলতে পারবে। তবে আমি মনে করি, এ ধরনের সিচুয়েশনে ইউজিসি এমন ভূমিকা নিতে পারে না।

আরও পড়ুন: সব স্কুল কলেজ মাদ্রাসা ও পলিটেকনিক অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবং শিক্ষার্থীদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের অভিপ্রায় অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুরোধ করেছি। এখন তারা তাদের সিন্ডিকেটে এটি নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে।

ইউজিসির কাজ কি? 
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরপরই ১৯৭২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আর্থিক বরাদ্দ এবং বিষয় অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু এখন দেশে ১১৫টি বেসরকারি ও ৫৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সময়ের ব্যবধানে বর্তমানে কাজ অনেক বিস্তৃত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্থিক অনুমোদন, বিষয় খোলা, গবেষণা, স্কলারশিপ এবং ফেলোশিপ, ইউজিসি লাইব্রেরি এবং উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প। এছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ব্যতীত সার্বিক তদারকির কাজটি করে থাকে এ সংস্থাটি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ খোলার মত কাজ ইউজিসির এখতিয়ারে নেই। অতীতে এ ধরনের নজির দেখা যায়নি দেশের উচ্চশিক্ষার এ তদারক সংস্থার কার্যাবলিতে।

এর আগে মঙ্গলবার দুপুরের পর কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে থাকা এক শিক্ষার্থীকে গুলি করে পুলিশ। পরে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ওই শিক্ষার্থী। নিহত আবু সাঈদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়টির কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।

আরও পড়ুন: অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ বেরোবি, দুপুরের মধ্যে হল হল ত্যাগের নির্দেশ

এরপর রাতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা এবং আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এরপর জরুরি সিন্ডিকেটে বসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বৈঠকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটির পাশাপাশি হলও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তীতে রাত ১০.০০ টার পর একটি জরুরি নির্দেশনায় দেশের সকল সরকারি এবং বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশনা জানিয়েছে দেশের উচ্চশিক্ষার তদারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। 

একই সাথে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণার কথা জানায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে ছুটির আওতায় রয়েছে—দেশের সব মাধ্যমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষাস্তর পর্যন্ত সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তবে ছুটি ঘোষণা করা হয়নি দেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষালয়গুলোতে।

এর আগে মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) চলমান আন্দোলনে সারাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজন নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাজধানীসহ সারাদেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ খবর পাওয়া যায়। নিহতের মধ্যে চট্টগ্রামে তিনজন, ঢাকায় তিনজন ও রংপুরে একজন রয়েছে। 

আরও পড়ুন: ঢাবির হলে হলে প্রাধ্যক্ষদের নোটিশ- ‘আজ থেকে হল ছাত্র রাজনীতিমুক্ত’!

এদিন বেলা তিনটার দিকে চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। এ সময় কয়েকজন অস্ত্রধারীকে গুলি করতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে হাতবোমার বিস্ফোরণও ঘটানো হয়। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছেন বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।

চট্টগ্রামে নিহত তিনজনের মধ্যে দুজনের পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন মো. ফারুক (৩২) ও মো. ওয়াসিম (২২)। ফারুক একটি আসবাবের দোকানের কর্মচারী এবং ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক বলে জানা গেছে। অপরজনের পরিচয় জানা যায়নি। এ ছাড়া আহত অন্তত ২০ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।

এরপর বিকেলে রাজধানীর ঢাকা কলেজের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের সংঘর্ষের মধ্যে এক যুবক নিহত হয়েছেন। তাঁর মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নিহত ওই যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর নাম-পরিচয় জানা যায়নি। এছাড়াও সন্ধ্যায় সিটি কলেজের সামনে থেকে রক্তাক্ত একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। 

আরও পড়ুন: সিটি কর্পোরেশন এলাকাভুক্ত সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা

এর আগে রবিবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা কোটা পাবে না, তো কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে?’ এমন বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে পড়েন।

এরপর সোমবার রাত থেকেই কোটা সংস্কার ইস্যুতে চলমান আন্দোলন নতুন রূপ পেতে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হল থেকে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এরপর রাত দুইটার দিকে তারা হলে ফিরে যান এবং আজ সকালে থেকেই আন্দোলন নতুন দানা বাধতে থাকে। পরবর্তীতে বিকেলের দিকে ছাত্রলীগ আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালালে সংঘর্ষ ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এখন পর্যন্ত নিহতের পাশাপাশি কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থীর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।


সর্বশেষ সংবাদ