গ্রাহকের আস্থা হারিয়ে ফেলছে দেশের ব্যাংক খাত

দেশের প্রথম সারির কয়েকটি ব্যাংক
দেশের প্রথম সারির কয়েকটি ব্যাংক  © লোগো

টানা কয়েক বছর ধরে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে৷ একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতিও জেঁকে বসেছে৷ এ খাতে এখন তার চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট৷ অথচ আর্থিক খাতের বড় শক্তিই হওয়ার কথা ছিল আস্থা ও বিশ্বাস৷ যেমন, আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে আমানতকারীরা তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ জমা রাখে ব্যাংকে৷ আবার ব্যাংক কর্তৃপক্ষও আস্থা ও বিশ্বাসের বিনিময়ে কাগজপত্র জামানত রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেন ঋণগ্রহীতাদের হাতে৷ অথচ সেই আস্থা আর বিশ্বাসটা এখন প্রায় তলানিতে৷

এ জন্যই ক্রেডিট রেটিং সংস্থা মুডিস বলছে, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ঋণমানের অবনমন হয়েছে৷ অন্যদিকে বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে অন্তত ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে৷ এর বেশিরভাগই আদায়যোগ্যতাও হারিয়েছে৷ প্রতি বছরই অনাদায়যোগ্য ঋণের পরিমাণও বাড়ছে৷ এজন্য অনেকটা বাধ্য হয়েই ব্যাংকগুলোতে ঋণ অবলোপন দেখাচ্ছে৷ শুধু তাই নয়- ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার মধ্যেও এখন আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছে৷ এর ফলে গত সাত বছরে অন্তত ডজনখানেক এমডিকে পদত্যাগ করানো হয়েছে৷ এ তালিকা থেকে বাদ যাননি চেয়ারম্যান ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকরাও৷

ন্যাশনাল ব্যাংকের মতো পুরোনো এবং ইসলামী ব্যাংকের মতো সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রেও ঘটেছে এমন ঘটনা৷ অবশ্য রাতারাতি তৈরি হয়নি এমন পরিস্থিতি৷ বছরের পর বছর অনিয়ম-দুর্নীতি, ঋণ জালিয়াতির বিচার না হওয়া এবং ব্যাংক খাতের ‘রাজনীতিকীকরণ'ই এর মূল কারণ৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের পরিচালককে হাত করে ব্যবস্থাপনাকে পাশ কাটিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা বের করে নিয়ে গেছেন৷ অবশ্য এত কিছুর পরও এ দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সাধারণ গ্রাহকরা মুখ ফিরিয়ে নেননি৷ এর কারণ হলো বিকল্প না থাকা৷ এখানে নন-ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন সম্পর্কে মানুষের ধারণা খুবই সামান্য৷ আর ইনস্যুরেন্স খাতকে কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য আর্থিক খাত মনে করা হয় না৷ ফলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে একাধিক ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেলেও এ দেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি গত দেড় দশকে৷ অবশ্য পদ্মাব্যাংকসহ আরো কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক সূচকে এতটাই অবনতি হয়েছে যে, সেগুলো বন্ধ করার উপক্রম হয়েছিল৷ তবুও সরকার এগুলোকে বন্ধ না করে উল্টো বিনিয়োগ করেছে৷ মালিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে৷ এটাকে অবশ্য এক ধরনের লাইফ সাপোর্টও বলা যেতে পারে৷

গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৯ দাঁড়িয়েছে হাজার ৪৮ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঘাটতি ১১ হাজার ৭৭৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা৷ আর বেসরকারি দেশি-বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঘাটতি ৭ হাজার ২৭২ কোটি ৬ লাখ টাকা৷

এদিকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা ও স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে রাজনৈতিক বলয়ের কারণে৷ এমনকি এই প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করেন তিনি গভর্নর৷ এই পদেও নিয়োগ দেওয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, যা অনেক দিন ধরেই হয়ে আসছে৷ যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকও পাবলিক ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত কোনো অবস্থান নিতে পারে না৷

এছাড়া ব্যাংক পরিচালকদের বেশিরভাগই শীর্ষ ব্যবসায়ী৷ এবং তারা কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷ এর ফলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ, ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন, ঋণ আদায়, ঋণের সুদহার বৃদ্ধি বা কমানো, খেলাপি ঘোষণা, ঋণ অবলোপন সবকিছুতেই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রাধান্য পেয়ে আসছে৷

এছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যাংক পরিচালকরা ব্যাংকগুলোকে নিজেদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভেবে এটাকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেন৷ অথচ এখানে আমানতকারীদের স্বার্থ থাকে৷ সাধারণ গ্রাহকদের স্বার্থ থাকে৷ ব্যাংক তো অন্য দশটা কোম্পানির মতো নয় যে যা ইচ্ছা তা করা যাবে৷ এখানে কোনো কিছু করতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে করতে হয়৷ কিন্তু সেটা মানা হয় না, যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো রুলস-রেগুলেশন এখানে কাজে আসে না৷ বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই৷ একই সঙ্গে অপরাধের শাস্তি বিধান করার পাশাপাশি অপরাধীকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা জরুরি৷ কিন্তু সেটা হয় না৷ বরং অসৎ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যাংক পরিচালকরা ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা মেরে দিয়ে নির্বিঘ্নে বিদেশে পালিয়ে যান এমন ঘটনাও ঘটেছে৷

এদিকে ব্যাংক খাতকে পুঁজি করে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করা হয়, যার প্রমাণও পেয়েছে বাংলাদেশ৷ অথচ সেসব ব্যাংকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷

সম্প্রতি তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৮২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দারা৷ তারা বলছেন, এটি পুরো ঘটনার ছোট একটি অংশ মাত্র৷ পাচারের আসল চিত্র আরও অনেক বড়৷

এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল একটি বিবৃতিতে আরও গভীর ও বিস্তৃত তদন্ত সাপেক্ষে অনুকম্পা বা ভয়ের ঊর্ধ্বে থেকে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক জবাবদিহি নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে৷ মূল সমস্যা হলো- ঘটনা ঘটার পর কিছুদিন এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হবে, কিছু তদন্তও হবে, কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না৷ দায়ী কোনো ব্যক্তির শাস্তিও হয় না- হবে না৷ ফলে কিছুদিন পর আবারও একই রকম ঘটনা ঘটবে৷ এটা যেন স্বাভাবিক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ হলো মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা এবং ব্যাংক খাতের অভিভাবক হিসেবে কাজ করা৷ সম্প্রতি সেই মুদ্রানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতির চাপ৷ একদিকে টানা কয়েক বছর ধরে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷ অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপও দুই অঙ্কের ঘরের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে, যা রীতিমতো সাংঘর্ষিক৷ মূল্যস্ফীতির চাপ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের বাইরে টাকার প্রবাহ বেড়েছে৷ ফলে জিনিসপত্রের দাম কোনোভাবেই কমছে না৷ ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ছে৷

জুন-২০২৩ পর্যন্ত মোট ছাপানো নোটের পরিমাণ ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি৷ এর বিপরীতে সার্কুলেশন তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা৷ সাধারণত দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাংক শাখার ভল্টে থাকে ১৪ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা৷ বাকি ২ লাখ ৯২ থেকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে৷

তবে এ কথা বলা যায় যে, করোনা মহামারি-পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছিল৷ এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের দর ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে৷ এ সময় বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দরও বেড়েছে৷ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা এর আগের মাস জুনে ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ৷এর মানে, এক বছর আগে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, তার তুলনায় এখন খরচ হচ্ছে প্রায় ১০ টাকা বেশি৷ অথচ বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়েনি৷ এতে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে৷

এছাড়া অব্যাহত ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক খাত সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে৷ আমদানি-রপ্তানির এলসি খোলা দুরুহ হয়ে পড়েছে৷ এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ভুলনীতি৷ কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক নিকট অতীতে ডলারের দাম কৃত্রিমভাবে ধরে রেখেছিল৷ ফলে ডলারের দর মুক্তবাজারে ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে দফায় দফায় কমেছে৷ বর্তমানে বাংলাদেশে ডলারের অফিসিয়াল রেট ১০৯ টাকা কিন্তু বাস্তবে ১১২ টাকা দিয়েও এলসি খোলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা৷ আর খোলা বাজারে তো ১১৭ টাকায়ও পাওয়া যায় না৷


সর্বশেষ সংবাদ