স্টার্টআপ লোন
৫০০ কোটির তহবিল থেকে বিতরণ হয়নি কোনও টাকা
- তৌহিদুর রহমান তুহি
- প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৫ PM , আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৬ PM
সমস্যা সমাধান ও নতুন কিছু করার আগ্রহ থেকে স্টার্টআপ গড়ে তোলার কথা ভাবেন তরুণেরা। কেউ কৃষি খাতে প্রযুক্তি আনছেন, কেউ তৈরি করছেন ঘরে বসে অনলাইনে শিক্ষা নেওয়ার অ্যাপ, আবার কেউবা নতুন নতুন সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের প্রযুক্তিনির্ভর সেবা চালু করছেন।
মূলত ব্যবসায়িক নতুন ধারণা, যা নির্দিষ্ট কোনো সমস্যার সমাধান করবে তাই স্টার্টআপ। যেটা এর আগে কেউ এতটা সহজভাবে করেনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্টার্টআপ হয় প্রযুক্তিনির্ভর। যেমন অ্যাপ, সফটওয়্যার বা ই-কমার্স, কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তি অথবা সামাজিক কোনো উদ্যোগ। স্টার্টআপ সাধারণত প্রচলিত ব্যবসা থেকে দ্রুত বড় হয়।
বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির অন্যতম বাঁধা অর্থের জোগান। সমস্যা সমাধানে ও বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও তথ্য-প্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার জন্য ২০২১ সালের মার্চে 'স্টার্ট-আপ ফান্ড' নামের ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সম্পূর্ণ জামানতবিহীন ঋণটি মাত্র ৪ শতাংশ সুদে একজন উদ্যোক্তাকে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা পর্যন্ত দেয়ার বিধান রেখে নীতিমালা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে চার বছরে সেই তহবিল থেকে বিতরণ হয়েছে ৫০ কোটিরও কম।
স্টার্টআপ খাতের জন্য ২০২১ সালের ২৯ মার্চ দুই ধরনের তহবিল গঠন করা হয়। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিল। দ্বিতীয়টি, ৫২টি তফসিলি ব্যাংকের মুনাফার ১ শতাংশ অর্থে গঠিত ব্যাংকগুলোর নিজস্ব স্টার্টআপ তহবিল। ব্যাংকদেশ ব্যাংক বলছে, এখন পর্যন্ত ২১৯টি উদ্যোগের অনুকূলে মাত্র ৪৮.৯৬ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে ৫২টি ব্যাংক। তবে এসব অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তাদের নিজস্ব স্টার্ট-আপ ফান্ড থেকে।
আরও পড়ুন: ব্যাংকের উদাসীনতায় ব্যয় হয় না সিএসআরের অর্থ, বঞ্চিত শিক্ষা খাত
গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক তথ্য দেখা গেছে, স্টার্ট-আপ ফান্ডে দেয়া তহবিল থেকে এক টাকাও খরচ করতে পারেনি ব্যাংক। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, নিজস্ব স্টার্ট আপ তহবিল শেষ করার পর, ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের স্টার্ট-আপ তহবিল থেকে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধার জন্য আবেদন করতে পারে।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ঋণের আবেদন প্রক্রিয়া সরলীকরণ, জামানতের শর্ত শিথিল করা এবং খাত ভিত্তিক বিশেষায়িত ঋণ চালু করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি চেম্বার, ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবিলম্বে একযোগে কাজ করে উপযুক্ত উদ্যোক্তা বাছাই প্রক্রিয়াকে আধুনিক করা প্রয়োজন। অন্যথায়, এই ধরনের উদ্যোগ কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে এবং বাস্তব অর্থনৈতিক কোনো প্রভাব থাকবে না।
এদিকে অনেক আলোচনার পর গত জুলাইয়ে প্রথমবারের মতো স্টার্টআপ খাতে ব্যাংক ঋণ ও ইক্যুইটি বিনিয়োগের জন্য বিস্তৃত নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এই নির্দেশনার ফলে উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার পাশাপাশি শেয়ারভিত্তিক অর্থও তুলতে পারবেন।
‘ব্যাংক তার জায়গা থেকে একসঙ্গে অনেক টাকা দিতে ভরসা করতে পারে না, আবার যারা স্টার্ট-আপ শুরু করেন তাদের প্রথম দিকে বড় অ্যাসেটও থাকে না। এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ যদি এমনভাবে দেয়া হয়, প্রথমে ট্রেড লাইসেন্স করতে ১০ হাজার টাকা, পরে ওয়েবসাইট করতে এক লাখ, পরের ধাপে ২ লাখ তাহলে শঙ্কা থাকবে না, পাশাপাশি এমন ফান্ডিং প্ল্যান করতে পারলে উদ্যোক্তারাও উপকৃত হবে।’- মোহাম্মদ শাহরিয়ার খান, ই-ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
এখন থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর মুনাফার অর্থ দিয়ে তৈরি প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার তহবিল থেকে ৪ শতাংশ সুদে ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো। আগে সর্বোচ্চ ঋণ দেয়া হতো ১ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে দুই বছরের কম বয়সী উদ্যোগে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত, ২-৬ বছর বয়সী উদ্যোগে ৫ কোটি টাকা ও ৬-১২ বছর বয়সী উদ্যোগে ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যাবে। ২১ বছরের বেশি বয়সের উদ্যোক্তারা এই ঋণের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এই ঋণ পেতে ক্রেডিট রেটিং সিস্টেম বা ঋণমান ব্যবস্থা পরিপালনের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। ফলে তহবিল পাওয়াটা সহজ হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
স্টার্টআপ খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পর্যাপ্ত অর্থায়নের অভাবে দেশের স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম বাড়াতে পারছে না। অথচ এ জন্য আলাদা তহবিল থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ঋণ নিতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। কারণ, অর্থায়ন পাওয়ার উপযোগী নীতিমালা ছিল না। এছাড়া স্টার্ট-আপ ফান্ড দেয়ার ক্ষেত্রে স্পেশালাইজড ব্যাংক ঠিক করা এবং ব্যাংক কর্মীদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ পড়া প্রয়োজন।
উদ্যোক্তাদের সংগঠন ই-ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও আইসিটি অলিম্পিয়াড বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ শাহরিয়ার খান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই স্টার্ট-আপ হচ্ছে স্বপ্ন। এক্ষেত্রে সরকার থেকে নেয়া মেধাস্বত্বই আমাদের অ্যাসেট। কিন্তু ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংককে এটা বুঝানো কঠিন। তারা আমাদের পোর্টফোলিও বা কোম্পানির অ্যাসেট ভ্যালু অনুমান করতে পারেন না। এজন্য স্পেশালাইজড ব্যাংক লক করা উচিত এবং ওই ব্যাংকের ক্রেডিট ম্যানেজারদের আগে ট্রেনিং দিতে হবে, যাতে তারা স্টার্ট-আপের ব্র্যান্ড ভ্যালুকে সঠিকভাবে অনুমান করতে পারেন।
আরও পড়ুন: পিপিএ-তে বড় পরিবর্তন, সরকারি কেনাকাটায় ই-জিপি বাধ্যতামূলক
ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মীদের অভাব রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, স্টার্ট-আপে বিনিয়োগ করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে ব্যাংক কর্মীদের দক্ষ করতে হবে, কেননা তারা উদ্যোক্তাদের ভেল্যু সঠিকভাবে যাচাই করতে অনেক সময় ব্যর্থ হন। তাদেরকে দক্ষ করা গেলে ঋণ বিতরণ সহজ হবে।
ব্যক্তিগতভাবে বেসরকারি একটি ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদন করেও অর্থ পাননি এই উদ্যোক্তা। তিনি জানান, এক্ষেত্রে ব্যাংকের রিকোয়ারমেন্ট ছিল ব্যবসার বয়স তিন বছরের বেশি হতে হবে, কিন্তু তিন বছর পর তো আমার ঋণ লাগবে না। স্টার্ট-আপ তিন বছর টিকে গেলে ফান্ডের কোনো প্রয়োজন হবে না।
‘ভিশন ২০২৪ এর আওতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জোর দেয়া হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর ঋণের চারভাগের একভাগ যেন অবশ্যই এসএমই খাতের উদ্যোক্তা হয়’- আরিফ হোসেন খান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক
এক্ষেত্রে ধাপে ধাপে ঋণ বিতরণের কথাও বলেন এই উদ্যোক্তা। তার কথায়, ব্যাংক তার জায়গা থেকে একসঙ্গে অনেক টাকা দিতে ভরসা করতে পারে না, আবার যারা স্টার্ট-আপ শুরু করেন তাদের প্রথম দিকে বড় অ্যাসেটও থাকে না। এক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণ যদি এমনভাবে দেয়া হয়, প্রথমে ট্রেড লাইসেন্স করতে ১০ হাজার টাকা, পরে ওয়েবসাইট করতে এক লাখ, পরের ধাপে ২ লাখ তাহলে শঙ্কা থাকবে না, পাশাপাশি এমন ফান্ডিং প্ল্যান করতে পারলে উদ্যোক্তারাও উপকৃত হবে। কারণ অধিকাংশ স্টার্ট-আপ আইডিয়ার ওপর শুরু হয়, তাদের ফাইনান্সিয়াল এবং এই একাউন্টিং লিগাল ডকুমেন্টগুলো থাকে না, অনেকের লাইসেন্সও থাকে না। হয়তো একটা আইডিয়াকে ফেসবুকে প্রমোট করে সেটার প্রোটোটাইপ করে মার্কেটে ছেড়ে দিছে। তখন ঋণ পেতে তার এসেট কী হবে?
এই ঋণের ক্ষেত্রে অল্প ইন্টারেস্টও একটা বাধা উল্লেখ করে শাহরিয়ার খান বলেন, সাধারণ ঋণের ক্ষেত্রে ১২-১৫ শতাংশ ইন্টারেস্ট, সেখানে স্টার্ট-আপে মাত্র ৪% ইন্টারেস্ট হওয়ায় অনেক ব্যাংক মনস্তাত্ত্বিকভাবেই এই ঋণ বিতরণে তেমন আগ্রহ দেখায় না। এছাড়া ফান্ড গঠনের পর বিষয়টি নিয়ে প্রচার প্রচারণারও ঘাটতি রয়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা অনেক সময় জানেন না, বা বোঝেন না কীভাবে সহজে এই ঋণ সহায়তা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য স্টার্টআপ খাত একটি সম্ভাবনাময় খাত। এ খাতে উদ্ভাবনী চিন্তা, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসা এবং নতুন পণ্য বা সেবা তৈরির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাজারে দেশের অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থায়ন না পাওয়ার কারণে অনেক প্রতিভাবান উদ্যোক্তা এবং সম্ভাবনাময় প্রকল্প পথেই থেমে যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ভিশন ২০২৪ এর আওতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের ২৫ শতাংশ সিএমএসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জোর দেয়া হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর ঋণের চারভাগের একভাগ যেন অবশ্যই এসএমই খাতের উদ্যোক্তা হয়। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বলতো তারা ঋণ দেয়ার জন্য সত্যিকার উদ্যোক্তা পাচ্ছেন না। এখন ব্যাংকের উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়েও অনেককে ঋণ দিচ্ছে না। আক্ষেপের বিষয় হলো- ব্যাংকগুলো যাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে তাদের ওপরই ভরসা করতে পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক আশা করছে, নতুন সার্কুলারের মাধ্যমে উদ্যোক্তা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তিন পক্ষের মধ্যে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা তৈরি হবে এবং স্টার্টআপ খাতের অর্থায়ন প্রক্রিয়াটি অধিকতর কাঠামোবদ্ধ ও কার্যকর হবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে, অন্যদিকে দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও উদ্ভাবনী অর্থনীতি গড়ে উঠবে।