জাল এমপিওভুক্তসহ ৬ অভিযোগ মাউশি পরিচালক অধ্যাপক শিশিরের বিরুদ্ধে, তদন্তে মন্ত্রণালয়

অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশির
অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশির  © ফাইল ছবি

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন) অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনৈতিক আচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। জাল এমপিওভুক্তি ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ ছয়টি অভিযোগ আমলে নিয়ে ১৪তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিষয়ে খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যদিও বিষয়টি অস্বীকার করে অধ্যাপক শিশির বলেন, ‘মাউশির ডিজি হওয়ার দৌঁড়ে আমি সবচেয়ে এগিয়ে। এজন্যই একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছেন।’ 

এদিকে অভিযোগের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা শাখা থেকে এ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহবায়ক করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-২)-কে। কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন বিভাগের উন্নয়ন-১ শাখার যুগ্মসচিব সাইদুর রহমান এবং সদস্য সচিব হিসেবে রয়েছেন উন্নয়ন-২ শাখার যুগ্মসচিব আহমেদ শিবলী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব আহমেদ শিবলী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘কমিটি গঠন হয়েছে। তবে অভিযোগগুলোর বিষয়ে এখনো তদন্ত শুরু হয়নি।’

‘মাউশির ডিজি হওয়ার দৌড়ে আমি সবচেয়ে এগিয়ে। এজন্য একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছেন। আমার শাখায় বদলি, এমপিওভুক্তি বা অন্য কোনো কাজ হয় না। ফলে অনিয়ম করার প্রশ্নই ওঠে না। মন্ত্রণালয় থেকে আমার কাছে জবাব চাওয়া হলে আমি জবাব দিতে প্রস্তুত আছি।—অধ্যাপক কাজী আবু কাইয়ুম শিশির, পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন), মাউশি

অধ্যাপক কাজী মো. আবু কাইয়ুম শিশিরের বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, তিনি নিজের লেখা বই প্রকাশের আয়োজনের নামে অর্থ লেনদেন, জালিয়াতি ও চাঁদাবাজির মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছেন। অভিযোগকারীরা বলছেন, তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে ছয়জন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করেছেন এবং বিভিন্নজনকে জোরপূর্বক অর্থ প্রদান করতে বাধ্য করেছেন।

এ ছাড়া পটুয়াখালী সরকারি কলেজে অধ্যাপনার সময় ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মোট  ৯০ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী ‘অসদাচরণ’ ও ‘পলায়ন’ শিরোনামে মন্ত্রণালয় থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেওয়া হয়েছিল। পরিচালক অধ্যাপক কাজী আবু কাইয়ুম মাউশির মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়া নিজ উদ্যোগে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত করছেন—যা সরকারি অভিযোগ প্রতিকার ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০১৫ (সংশোধিত ২০১৮) এর পরিপন্থী। এছাড়া বিভিন্ন অফিস পরিদর্শনের নামে কর্মকর্তাদের হয়রানি ও বিব্রত করার অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, জামালপুরের সাধুরপাড়া নজরুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ের একাধিক ভুয়া নিয়োগ ও এমপিওভুক্তির ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন শিশির। সংশ্লিষ্ট নথি অনুযায়ী, বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক নুর মুহাম্মদ ২০২৩ সালে জাল কাগজপত্র তৈরি করে ছয়জনকে ব্যাকডেট দেখিয়ে নিয়োগ দেন এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও মার্চে এমপিওভুক্ত করান। এদের কেউই শিক্ষক নিবন্ধনধারী নন এবং বিদ্যালয়ের হাজিরা খাতা, জরিপ বা অডিট রিপোর্টে তাদের কোনো নাম নেই। তদন্তে জানা যায়, তারা কখনও শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেননি। এমনকি শিক্ষা অফিসার ও সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে এমপিও ফাইল পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় চলতি বছরের মার্চে মাউশি অভিযুক্তদের শোকজ করা হয়েছে। 

বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ লিখিত অভিযোগে বলেছেন, জাল নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতন ছাড় করেননি তিনি। কেননা এমপিওর নিয়ম অনুযায়ী ভুল বেতন ছাড়ের দায়ভার প্রতিষ্ঠানপ্রধানকেই নিতে হয়। তবে মাউশির পরিচালক অধ্যাপক কাজী আবু কাইয়ুম তার অনুমতি ছাড়াই ইএমআইএস সেলের মাধ্যমে ওই ছয়জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংশোধন দেখিয়ে ২০২৫ সালের ১০ জুলাই ইএফটির মাধ্যমে তাদের বেতন প্রেরণ করেছেন। তার দাবি, পরিচালক কাইয়ুম ১৮ জুন তাকে টেলিফোনে বেতন ছাড়ের জন্য হুমকি দেন এবং একদিনের আল্টিমেটাম দেন। বিষয়টি লিখিতভাবে জানালে তিনি মাউশিতে প্রয়োজনীয় নথি জমা দেন।

এ ঘটনায় বিদ্যালয়সংলগ্ন এলাকাবাসীর পক্ষ থেকেও অভিযোগপত্র পাঠানো হয়েছে মাউশিতে। ওই অভিযোগে বলা হয়, বিদ্যালয়টি দুর্নীতির কারণে ধ্বংসের পথে। তদন্ত চললেও অভিযুক্তরা এলাকায় প্রকাশ্যে প্রচার করছে যে, মাউশির এক পরিচালককে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত হলেও তারা প্রভাব খাটিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। জালিয়াতি চক্র এবং যারা তাদের বাঁচাতে কাজ করছে—তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির একাধিক কর্মকর্তার মতে, এ ধরনের অভিযোগ শিক্ষা প্রশাসনের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদঘাটন জরুরি।

যদিও নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাউশির পরিচালক অধ্যাপক কাজী আবু কাইয়ুম শিশির। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘মাউশির ডিজি হওয়ার দৌড়ে আমি সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছি। এজন্য একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছেন। আমার শাখায় বদলি, এমপিওভুক্তি বা অন্য কোনো কাজ হয় না। ফলে অনিয়ম করার প্রশ্নই ওঠে না। ইএফটিতে বেতন-ভাতার কাজ করে ইএমআইএস সেল। ওই সেলের সাথে আমি সম্পৃক্ত না। অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। মন্ত্রণালয় থেকে আমার কাছে জবাব চাওয়া হলে আমি জবাব দিতে প্রস্তুত আছি।’


সর্বশেষ সংবাদ