নিরাপদ সড়ক চাওয়া শিক্ষার্থীদের দুর্বিষহ জীবন, নিরাপদে ‘হেলমেট বাহিনী’

  © ফাইল ফটো

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী আবদুল করিম (রাজীব) ও দিয়া খানম (মীম) নিহত হয়। এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামেন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১০ দিন ধরে চলা ওই আন্দোলন ঘিরে শিক্ষার্থীসহ কয়েকশ’ ব্যক্তির নামে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৬০টি মামলা হয়। এসব মামলার বেশির ভাগ আসামিই অজ্ঞাতনামা।

তখন এসব মামলায় গ্রেপ্তার করে ৯৯ জনকে কারাগারে পাঠানাে হয়। এঁদের মধ্যে ৫২ জন শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থী এখন জামিনে থাকলেও আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাঁদের। তবে গত মার্চ মাস থেকে করােনার কারণে আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আপাতত তাঁদের হাজিরা দিতে হচ্ছে না।

দুই বছর আগে নিরাপদ সড়ক দাবিতে ওই আন্দোলনে অন্যদের সঙ্গে অংশ নেন ঢাকা পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউটের শিক্ষার্থী তারিক আজিজ। আন্দোলন শেষ হওয়ার এক মাস পর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে টঙ্গীর বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর জানতে পারেন, রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার নামে নয়টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তারের ১০ মাস পর জেল থেকে জামিনে ছাড়া পান তিনি।

জেল থেকে আপাতত মুক্তি পেলেও ভােগান্তির শেষ হয়নি তারিকের। প্রতি মাসে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে তাঁকে। গত সোমবার মোবাইলে তিনি বলেন, কোনাে মাসের নয় দিনই চলে গেছে হাজিরা দেওয়ার জন্য আদালতে যাওয়া-আসা করতে করতে। জেলে থাকার কারণে দুটি সেমিস্টারের ফল খুব খারাপ হয়েছে। মনে হচ্ছে, ভয় আর মামলাতেই আটকে গেছে জীবন।

আন্দোলনের মাঝপথে ২০১৮ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর জিগাতলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযােগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নির্মম হামলার শিকার হন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা ধানমন্ডির দিকে যেতে চাইলে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মােড়সহ বিভিন্ন এলাকায় হামলার শিকার হন। সেদিন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয় ১২ জন সাংবাদিককেও।

হামলাকারীদের অনেকের মুখ হেলমেটে ঢাকা থাকায় তারা ‘হেলমেট বাহিনী’ নামে পরিচিত পায়। দুই বছর হয়ে গেলেও হামলাকারীদের কারও বিরুদ্ধে এখন পর‌্যন্ত মামলা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরকারের বিভিন্ন পর‌্যায় থেকে ওই সময়ে হামলাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের আশ্বাস দেওয়া হয়। কিছুদিন পর সরকার বিষয়টি ‘ভুলে’ যায়।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়টি যাতে দ্রুত সুরাহা হয়, সেই তাগাদা দিয়ে তিনি শিগগিরই জননিরাপত্তাসচিবকে চিঠি দেবেন। তিনি বলেন, সবাইকে এভাবে ঝুলিয়ে রাখার তাে মানে হয় না।

জেল খেটে বেরিয়ে আসা নয়জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে গত সপ্তাহে কথা হয়েছে। তাঁরা বলছেন, অধিকাংশ মামলার বাদী পুলিশ। যে কারণে এসব মামলার প্রভাব ব্যক্তিজীবনে বহুমুখী। কেউ কেউ শিক্ষাজীবন শেষ করা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। কোনভাবে শিক্ষা জীবন শেষ হলেও মামলার কারণে সরকারি চাকরি না পাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন কেউ কেউ।

শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে করা এসব মামলার বিষয়ে সরকারের কোনাে সিদ্ধান্ত আছে কি না জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মামলাগুলো পেন্ডিং অবস্থায় আছে।’ নিষ্পত্তি বা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনাে উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার একক সিদ্ধান্তে তাে নিষ্পত্তি হবে না বুঝতেই পারছেন। সিদ্ধান্ত আরও ওপর থেকে আসতে হবে।’

পুলিশের করা বিভিন্ন মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে তখন দুই কারণে মামলা হয়। প্রথমত, রাজপথে আন্দোলন করার কারণে। এ ক্ষেত্রে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, ভাঙচুরের অভিযােগ আনা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ ছাত্রসহ শত শত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রচার চালানো। এছাড়া গুজব ছাড়ানো হয়েছে এমন অভিযোগও করে পুলিশ।

আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলার অন্যতম কারণ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়া ও ভিডিও শেয়ার করা। এ ক্ষেত্রে অভিযােগ আনা হয় ফেসবুক, টুইটার, ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ, ইউটিউব, অনলাইন নিউজ পাের্টাল, ব্লগে বিভিন্ন উসকানিমূলক লেখা, পােস্ট, ফটো বা ভিডিওর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানাের। অভিযােগ ছিল গুজব ছড়ানােরও।

তবে দুই বছর পার হয়ে গেলেও এখনাে গুজবের উৎসের সন্ধান পায়নি পুলিশ। ডিএমপির সাইবার অপরাধ দমন বিভাগের উপকমিশনার এ এফ এম কিবরিয়া বলেন, যারা গুজব ছড়িয়েছিল, তাদের অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। মামলাগুলাে এখনাে তদন্তাধীন রয়েছে।

ওই সময় শুধু জিগাতলা, সায়েন্স ল্যাবরেটরি মােড়েই নয়, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয় মিরপুরেও। এ ছাড়া ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ অবস্থাতেই হামলার শিকার হন। এসব ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের সহযােগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জড়িত। এ ছাড়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন শিক্ষার্থীরা।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলােকে আইনের অপপ্রয়ােগ ও অপব্যবহার বলে মনে করেন বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, দু-একজনের বিরুদ্ধে যদি অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তাদের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত। অন্য মামলাগুলো দীর্ঘায়িত না করে তুলে নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। ইদানিং দেখা যাচ্ছে, কোন ভিত্তি বা স্বল্প ভিত্তি না থাকলেও ফৌজদারি আইনের অপব্যবহার করে প্রতিবাদ মিছিল, আন্দোলন ও বিরুদ্ধ মতকে দমন করা হচ্ছে। সূত্র: প্রথম আলো।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence