ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে ৬০০, শৃঙ্খলা কি ফিরবে?

 ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছেন শিক্ষার্থীরাও
ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি কাজ করছেন শিক্ষার্থীরাও  © সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের জেরে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সারাদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কার্যত ভেঙে পড়ে। এর বেশি প্রভাব ছিল ঢাকায়। দীর্ঘ স্বৈরশাসনে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণের ফলে সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়ে। এর সবচেয়ে বাজে প্রভাব পড়ে পুলিশের ওপর। সারাদেশে থানার পাশাপাশি সড়কও ট্রাফিক পুলিশশূন্য হয়ে যায়। সড়কে নেমে আসে চরম বিশৃঙ্খলা।

এমন পরিস্থিতিতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এগিয়ে আসে শিক্ষার্থীরা। টানা ৬ দিন তারা দিন-রাত পরিশ্রম করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। এরপরও রাজধানীতে যান চলাচলে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হয়নি। ট্রাফিক পুলিশের অবর্তমানে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীদের এই ভূমিকা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। তাই তাঁদের সহায়ক পুলিশ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। বর্তমানে সড়কের বিভিন্ন মোড়ে শিক্ষার্থীরা দুই শিফটে কাজ করছেন। গত তিন মাসে তাদের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০ জনে।

তবে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়লেও ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি। প্রতিদিনই ট্রাফিক সিগন্যাল উপেক্ষা করে চলতে থাকা যানবাহন, অতিরিক্ত গতির গাড়ি ও চরম যানজটের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। তারপরও পুলিশ এবং শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আশাবাদী মন্তব্য শোনা যায়।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের তথ্য মতে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট সময় ধরে দায়িত্ব পালন করতে বলা হচ্ছে, এবং প্রতিদিন ৪০৫ টাকা করে সম্মানী দেওয়া হচ্ছে। তারা মূলত দুই শিফটে কাজ করছেন—প্রথম শিফটটি সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় শিফটটি বিকেল ৪টা ৩০ মিনিট থেকে রাত ৮টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত।

শিক্ষার্থীদের কাজের মধ্যে রয়েছে— যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা, সঠিক লেনে চালককে পরিচালনা করা। উল্টোপথে যান চলাচল বন্ধ করা।  পথচারীদের ট্রাফিক আইন মেনে চলতে উৎসাহিত করা। নির্ধারিত জায়গায় বাসযাত্রীদের দাঁড়াতে সহায়তা করা।  সড়ক-মোড়ে কোনো ধরনের গাড়ি পার্কিং হতে না দেওয়া।

এসব কাজ শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করছেন, কিন্তু কিছু জায়গায় সঙ্কট এখনও বিদ্যমান।

ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি, শিক্ষার্থীদের যোগদান ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।  একজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষার্থীরা দায়িত্বপূর্ণভাবে কাজ করছেন, তবে তাদের উপস্থিতি সড়কে পুরো শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট নয়। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরাতে নাগরিকদেরও আইন মানতে হবে।

এদিকে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এখন পর্যন্ত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার্থীদের যোগদান অনেক সহায়ক হয়েছে। তবে সড়কের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এখনো জনসচেতনতার অভাব রয়েছে।  আমরা যদি ট্রাফিক আইন না মানি, তাহলে শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিয়ে পুরো ব্যবস্থাপনা চালানো সম্ভব হবে না।

শিক্ষার্থীরা সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছেন, তবে তাদের কাজের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব মিশ্র। অনেকেই প্রশংসা করছেন, আবার কিছু ক্ষেত্রে তারা বিরক্তিও প্রকাশ করেছেন।

রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় গাড়ি পার্কিং করা আবু সায়েদ নামের এক ব্যক্তির মতে, শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট সহানুভূতির সঙ্গে কাজ করছে, তবে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য আরো কঠোর পদক্ষেপের প্রয়োজন।

অপর দিকে, এক পথচারী বলেন, শিক্ষার্থীরা কাজ করছেন, তবে কখনো কখনো তারা নিয়মের বাইরে চলে যান। বিশেষ করে যখন কোনো গাড়ি চালক তাদের কথা শোনে না, তখন অনেক সময় তারা উত্তেজিত হয়ে যান। এর ফলে সামান্য ঝামেলা হয়।

তিনি আরও বলেন, যদিও শিক্ষার্থীরা কাজ করছেন, তবে তাদের কাজের ক্ষেত্রে কিছু বাধা রয়েছে। প্রথমত, ট্রাফিক সিগন্যালের সঠিক প্রয়োগের অভাব রয়েছে। সিগন্যাল ব্যবস্থার অভাব বা অনেক জায়গায় ট্রাফিক সিগন্যালের নষ্ট হওয়া, এটা শিক্ষার্থীদের কাজের কঠিন করে তোলে।

একাধিক শিক্ষার্থী জানান, অনেক সময় গতি ধারণকারী গাড়ি কিংবা ট্রাফিক সিগন্যাল উপেক্ষা করা চালকরা আমাদের কথা শোনে না। ফলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে পড়ে।

অন্যদিকে, যানজটের কারণে সড়কে অনেক সময়ে তাদের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজের ফল পাওয়া যায় না। তবে তারা দাবি করছেন, নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আরো ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের যোগদান ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও, তাদের এককভাবে দায়িত্ব দেওয়া যথেষ্ট নয়। শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা সমাধানের জন্য অবকাঠামোগত পরিবর্তন এবং কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করলেই চলবে না, সড়কের সব ধরনের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে। সিগন্যালের ওপর কঠোর নজরদারি, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং পরিবহন আইন শক্তিশালী করতে হবে।

একজন ট্রান্সপোর্ট বিশেষজ্ঞ বলেন, ঢাকার যানজট সমস্যা সহজে সমাধানযোগ্য নয়। সড়কগুলো সরল, বর্ধিত করতে হবে, এবং নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেই সাথে ট্রাফিক পুলিশের শক্তিশালী উপস্থিতি ও আইনের সঠিক প্রয়োগ আবশ্যক।

শিক্ষার্থীদের সহায়তায় ঢাকার সড়কগুলোতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করা হলেও, এর দ্বারা পুরো ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন সম্ভব হবে না। সড়ক ব্যবস্থাপনায় কঠোর আইন প্রয়োগ, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে দুর্ঘটনা কমানো এবং যানজট নিরসনে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।  অবশেষে, রাজধানীর বাসিন্দাদেরও সচেতন হতে হবে—তাহলে সম্ভব হবে একটি সুশৃঙ্খল যানবাহন ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা।


সর্বশেষ সংবাদ