ভোটের আগে গুমের বিচার সম্পন্নের দাবিতে রাজশাহীতে মানববন্ধনে
- রাজশাহী প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০৭:২৪ PM , আপডেট: ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১০:৩৪ PM
আন্তর্জাতিক গুম দিবসে রাজশাহীতে গুম হওয়া পরিবারের স্বজনরা ফেরত পাওয়ার আকুতি জানিয়ে ভোটের আগেই দায়ীদের বিচার সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত র্যালি ও মানববন্ধনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের আহাজারি আর ফিরে আসা ভুক্তভোগীদের বেদনাবহ বক্তব্যে আবেগঘন হয়ে ওঠে সাহেব বাজার জিরো পয়েন্ট।
শনিবার (৩০ আগস্ট) মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর উদ্যোগে সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে এ মানববন্ধন করা হয়।
গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা এখনো তাদের প্রিয়জনদের ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও এই মানুষগুলোর কেন খোঁজ মিলছে না?’ আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার সংগঠন 'অধিকার'-এর আয়োজনে রাজশাহী মহানগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে আয়োজিত এক মানববন্ধনে তাঁরা নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধান এবং গুমের সাথে জড়িতদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে ভোটের আগেই বিচার সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছেন।
তাদের দাবি, শেখ হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েই নিখোঁজ হয়েছেন কেউ বাবা, কেউ সন্তান, কেউ স্বামী, আবার কেউ ভাই। বছরের পর বছর ধরে গুম হওয়া স্বজনদের অপেক্ষায় থাকা পরিবারের সদস্যদের কান্না ও আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টের পরিবেশ। তারা নিখোঁজদের ফেরত পাওয়ার আকুতি জানান।
র্যালি ও মানববন্ধনে গুম হওয়া পাঁচটি পরিবারের সদস্য তাঁদের প্রিয়জনের ছবি হাতে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় গুম থেকে ফিরে আসা সাতজন ব্যক্তিও তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন।
গুমের ঘটনা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হলেন আতিকুল ইসলাম। মানববন্ধনে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, কিন্তু সরকারি বাহিনী কোন আইনি ক্ষমতাবলে তাঁদের গুম করেছিল?’ তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের মতো অসংখ্য পরিবার যেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এই কষ্ট বয়ে না যায়। গুমের ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।’
তিনি গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফেরত দেওয়ার পাশাপাশি ‘আয়নাঘর’ নামক নির্যাতন কেন্দ্র বিলুপ্ত করারও দাবি জানান। মানববন্ধনে গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের পিতা বা স্বামী জীবিত না মৃত, আমরা পিতৃহারা না বিধবা—এর নিশ্চয়তা চাই। আমরা চাই গুমের সাথে জড়িতদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে ভোটের আগেই বিচারের কার্য সম্পন্ন করা হোক।’
‘অধিকার’-এর রাজশাহী সমন্বয়ক ও ‘দৈনিক আমার দেশ’-এর ব্যুরো প্রধান মঈন উদ্দিনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এই মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. ইফতেখারুল আলম মাসউদ, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহকারী মহাসচিব ও আরইউজে-এর সাধারণ সম্পাদক ড. সাদিকুল ইসলাম স্বপন, ছয় মাস গুম থাকার পর ফিরে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা আতিকুল ইসলাম, গুম হওয়া আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী জামিল আক্তার, গুম হওয়া মুরশিদুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা বিবি, গ্রিন ভয়েস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আহসান হাবীব, স্টুডেন্ট অ্যাক্টিভিস্ট মাহমুদুল হাসান এবং আরিফুল ইসলাম।
পরে ছয় মাস পর গুম থেকে ফিরে আসা আলামিন হোসেন মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর একটি বিবৃতি পাঠ করে শোনান।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন গুম থেকে ফিরে আসা মিজান ইসলাম, আল-আমিন, মাসুদ রানা, মিজান, বুলবুল ইসলাম এবং মো. সুমন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন রাজশাহী রিপোর্টার্স ইউনিটির সহসভাপতি ও মানবাধিকার কর্মী মাসুদ রানা রাব্বানী, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক কাজী নুরুল আলম, মানবাধিকার কর্মী আনোয়ার হোসেন ফিরোজ, মানবাধিকার কর্মী এম শামিম আক্তারসহ শতাধিক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
প্রতিকূল আবহাওয়া এবং প্রচণ্ড গরম উপেক্ষা করে রাজশাহী মহানগরীর প্রায় শতাধিক সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী মানববন্ধনে অংশ নেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর পক্ষ থেকে তাঁদের রাজশাহী সমন্বয়ক মঈন উদ্দিন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ১০টি দাবি তুলে ধরেন। এগুলো হলো সব গুমের ঘটনায় স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত পরিচালনা করতে হবে; গুম অবস্থা থেকে ফেরত না আসা ব্যক্তিদের অনুসন্ধানের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে জাতীয় কৌশল গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি; গুম থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা বা সাজানো মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে; গুম অবস্থা থেকে ফেরত না আসা ব্যক্তিদের পরিবার যেন তাঁদের ব্যাংক হিসাব, সম্পদ ও সম্পত্তি পরিচালনা করতে পারে সে জন্য ‘সার্টিফিকেট অব অ্যাবসেন্স’ (Certificate of Absence) প্রদান করা এবং ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণের বিধান রেখে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে; সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯ বাতিল বা সংশোধন করতে হবে; গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-কে বিলুপ্ত করতে হবে; গুমের প্রমাণ ধ্বংসের সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে; ভুক্তভোগী ও তাঁদের পরিবারের দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তি বন্ধে ন্যায্য, স্বচ্ছ ও দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে ও আইসিপিপিইডি (ICPPED) বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মান অনুযায়ী ফরেনসিক, আইনি ও তদন্তে সক্ষমতা বাড়াতে বাংলাদেশ সরকারের কারিগরি ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।