গুম ছিল রাজনৈতিক অস্ত্র, সবচেয়ে বেশি নিখোঁজ ২০১৭ সালে
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২৫, ১১:৩৩ AM , আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২৫, ০৭:৫৪ PM

বাংলাদেশে গুমের প্রবণতা শুধুমাত্র অপরাধ দমন নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন থেকে।
২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৫৩টি গুমের ঘটনার বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সবচেয়ে বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে ২০১৭ সালে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের বছর। ওই বছর এককভাবে ৫১টি গুমের তথ্য যাচাই করেছে কমিশন।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ১০১ জনের রাজনৈতিক পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। এদের মধ্যে বিএনপির ৩৭ জন, ছাত্রশিবিরের ৩১ জন এবং জামায়াতের ২৫ জন ছিলেন। আওয়ামী লীগেরও দুজন গুমের শিকার হয়েছেন, তবে তা দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তিগত বিরোধজনিত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের শিকারদের জিজ্ঞাসাবাদে রাজনৈতিক পরিচয় ছিল সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধানের বিষয়। এতে প্রতীয়মান হয়, এ ধরনের নিখোঁজ হওয়া ছিল মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যা ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করার অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
গুম হওয়া ২৫২ জনের বয়স বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি। ২৭ থেকে ২৮ বছর বয়সীদের মধ্যে সর্বাধিক গুমের শিকার পাওয়া গেছে। এতে বোঝা যায়, ভুক্তভোগীরা ছিলেন এমন এক বয়সসীমায়, যখন একজন রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন।
এছাড়া অন্তত ১০ জন ভুক্তভোগী ছিলেন ১৮ বছরের কম বয়সী। তবে চরমপন্থা নয়, রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল গুমের প্রধান কারণ, এমন মন্তব্যই উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
গুমের শিকারদের পেশাগত পরিসংখ্যানও তা-ই বলছে। মোট ২২৮ জনের পেশাগত পরিচয়ের মধ্যে ৬৬ জন ছাত্র, ৬৪ জন ব্যবসায়ী, ৩৪ জন শিক্ষক, ৩৩ জন বেসরকারি চাকরিজীবী, ১০ জন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং ৫ জন সাংবাদিক ছিলেন।
গুমের শিকার অনেকেই নিখোঁজ ছিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় অর্ধেক ভুক্তভোগী ৪৭ দিনের কম সময় নিখোঁজ ছিলেন, আর বাকিরা এর চেয়ে দীর্ঘ সময় আটক বা নিখোঁজ ছিলেন। কেউ কেউ পাঁচ বছর পর্যন্ত নিখোঁজ ছিলেন।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে গুমের তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১২ সাল ছাড়া প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটেছে। কমিশনের তদন্ত করা ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০১০ সালে ৪ জন, ২০১১ সালে ২ , ২০১৩ সালে ৩ ও ২০১৪ সালে ৮ জনকে গুম করা হয়। এরপর গুমের সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। ২০১৫ সালে ২১, ২০১৬ সালে ৩২ এবং পরের বছর তা সর্বোচ্চ ৫১ হয়। ২০১৮ সালে ৩৭, ২০১৯ সালে ৩৩ ও ২০২০ সালে ১৪ জন গুম হয়। ২০২১ সালে গুমের ঘটনা আবার বেড়ে ১৮ এবং পরের বছর তা ২৪ হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ৬ জনের গুম হওয়ার তথ্য যাচাই করা হয়েছে।
কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন মন্তব্য করেছেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনে জনগণ সরাসরি পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছে। তখন নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে সেই রকম প্রতিবাদ ঠেকাতে সরকার রাজনৈতিক বিরোধীদের নিঃশব্দে সরিয়ে দেওয়ার পথ বেছে নেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গুমের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, সেগুলোর লক্ষ্য ছিল রাজনীতিতে সক্রিয় বা সক্রিয় হওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষদের দমন করা।’