বিসিএস ভাইভা: প্রতিদিনই কিছু সময় ইংরেজিতে কথা বলতাম
- এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
- প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০১৯, ০৬:০৬ PM , আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:৪৮ PM
আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা, সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস, সাহসের সাথে ভাইভা মোকাবেলা করা এবং কার বোর্ডে ভাইভা পড়লো, কোন স্যার কেমন মার্কিং করেন ভাইভার আগে এসব নিয়ে চিন্তা না করাই উত্তম— বলছিলেন তানজিমা আঞ্জুম সোহানিয়া। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। ৩৭তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করে বর্তমানে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করছেন। তার বিসিএস ভাইভা অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প করেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে। লিখছেন— এম এম মুজাহিদ উদ্দীন।
৩৭ তম বিসিএস’র রিটেন পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকেই মনে হচ্ছিল ভাইভার জন্য ডাক পাব, তাই মনের অজান্তে একটু ভয় নিয়েই টুকিটাকি ভাইভার প্রস্তুতি শুরু করি।এই প্রস্তুতি ছিল প্রতিদিন বাংলা ও ইংরেজী ২টি পেপার পড়া, সামপ্রতিক ঘটনাবলীর উপর নজর রাখা ও বিভিন্ন গল্প-সাহিত্য পড়া ইত্যাদি। পরবর্তীতে রিটেনের রেজাল্ট হওয়ার পর ভাইভার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।
যেহেতু পররাষ্ট্র আমার প্রথম পছন্দ ছিল তাই আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী ও ওয়ার্ল্ড ম্যাপের উপর একটু বেশি জোর দিয়েছিলাম। সাথে মুক্তিযুদ্ধ, নিজ জেলা, নিজের পঠিত বিষয়, বাংলাদেশ বিষয়াবলী ও ২য় পছন্দ প্রশাসন ক্যাডারের খুটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ের উপর সম্যক ধারণা নিয়েছিলাম। এছাড়া পররাষ্ট্র প্রথম পছন্দ হওয়ায় পরিচিতজনদের সাথে প্রতিদিন কিছুসময় ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করতাম।
অবশেষে কাঙ্খিত সেই দিনটি এল। যদিও এর আগে ৩৬তম বিসিএস এবং বর্তমানে কর্মরত সরকারি চাকরির ভাইভায় মুখোমুখি হয়েছিলাম তাই ৩৭তম বিসিএস ভাইভা নিয়ে একটু নার্ভাসনেস কাজ করলেও মনের এককোণে কিছুটা সাহসও পাচ্ছিলাম। ভাইভাতে যেহেতু মার্জিত পোশাক পড়তে হয়, সেটা মাথায় রেখে আমি হালকা গোলাপি রংয়ের একটি জামদানি শাড়ি পরেছিলাম।
আমার ভাইভা ছিল মোখলেসুর রহমান স্যারের বোর্ডে। স্যারসহ তিনজন মেম্বার স্যার ছিলেন। আমাকে মূলত আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী, পররাষ্ট্র ও প্রশাসন ক্যাডার সর্ম্পকিত কিছু মৌলিক প্রশ্ন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিষয়াবলীর উপর বেশিরভাগ প্রশ্ন করেছিল।
এছাড়াও নিজের সর্ম্পকে, নিজ জেলা ও কেন ক্যাডার সার্ভিসে আসতে চাই এ সর্ম্পকিত প্রশ্ন করেছিল। আমার ভাইভা বাংলা ও ইংরেজী উভয় মাধ্যমেই হয়েছিল। ভাইভাটি ছিল ১৫ থেকে ২০ মিনিটের। ভাইভা মোটামুটি ভালো হয়েছিল কিন্তু বোর্ড চেয়ারম্যান স্যারের এক্সপ্রেশন দেখে বুঝতে পারিনি স্যার আমাকে কেমন মার্কস দিলেন। তবে আমি মনে মনে আশাবাদী ছিলাম হয়তো ভাল কিছুই হবে।
সর্বোপরি আমার কাছে মনে হয় আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা, সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখা, সাহসের সাথে ভাইভা মোকাবেলা করা এবং কার বোর্ডে ভাইভা পড়লো, কোন স্যার কেমন মার্কিং করেন ভাইভার আগে এসব নিয়ে চিন্তা না করাই উত্তম।
ভাইভা প্রার্থীদের জন্য ৩ সতর্কতা ও ১০ পরামর্শ
লিখিত পরীক্ষায় অনেক কম নম্বর নিয়েও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করলে আপনি ক্যাডার হয়ে যেতে পারেন। তাই মৌখিক পরীক্ষায় ভালো করার জন্য ভালো প্রস্তুতি একান্ত প্রয়োজন। মৌখিক পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের প্রস্তুতি সম্পর্কে বিসিএস ক্যাডার প্রত্যাশীদের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন ৩৬তম বিসিএস ট্যাক্স (সহকারী ট্যাক্স কমিশনার) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত এস. এম. নজরুল ইসলাম।
শুধু কোনো পরীক্ষার ভাইভার জন্য নয়, যেকোনো ক্ষেত্রে সফল হতে হলে কথা বলার সময় যে তিনটি বিষয়ের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো স্বচ্ছতা, স্পষ্টতা এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। অন্যদিকে ভাইভা দেওয়ার সময় তিনটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে হলো-
১) আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে, কোনোভাবেই নার্ভাস হওয়া যাবে না;
২) ক্যাডারসুলভ আচরণ করতে হবে;
৩) দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধিভিত্তিক এবং প্রাণবন্ত থাকতে হবে।
এছাড়া নিম্নোক্ত ১০ টি বিষয়ে গুরুত্ব দিলে ভাইভাতে ভালো করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। নিম্নে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো-
১) নিজ সম্পর্কে জানা
নিজের নামের অর্থ, নামের সঙ্গে মিল আছে এমন বিখ্যাত ব্যক্তি এবং পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। আপনার পছন্দের কবি, সাহিত্যিক, সাহিত্য, গান, খেলাধুলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আপনার পছন্দের বিষয়গুলো সম্পর্কে আগে থেকেই ভালোভাবে প্রস্তুতি নিলে ভালো করা সম্ভব।
২) নিজ জেলা ও উপজেলা
আপনার নিজ জেলা ও উপজেলার বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন। আপনার নিজ জেলায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বিখ্যাত মুক্তিযুদ্ধার নাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার জেলা কত নম্বর সেক্টরে ছিল ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে হবে। এছাড়াও আপনার জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি সম্পর্কেও জেনে নিতে হবে। আপনার জেলা ও উপজেলার বিখ্যাত নদী, বন্দর, বিখ্যাত স্থান। অপনার জেলার যদি কোনো কবি ও সাহিত্যিক থাকে তাদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
৩) বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ
আপনার বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভাগ সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত শিক্ষক এবং কি জন্য তা বিখ্যাত এ সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার বিশ্ববিদ্যালয় ও হলের যদি কোনো অবদান থাকে সে সম্পর্কেও ধারণা নিতে হবে। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি এবং তিনি কোন বিভাগের সে সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে।
৪) নিজ ক্যাডার পছন্দক্রম
বিসিএস পরীক্ষায় যে সব বিষয় পছন্দক্রম দিয়েছেন সেগুলোর মধ্য থেকে প্রথম তিনটি বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। প্রতিটি ক্যাডারের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং এ ক্যাডারের মাধ্যমে আপনি কিভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে চান এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধারতে হবে। কোনো প্রকার অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে আপনি পূর্ব থেকে প্রস্তুতি নিতে পারলে ভালো করবেন।
৫) মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ
১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ তথা ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আলোচিত বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে যারা অসামান্য আবদান রেখেছেন তাদের সম্পর্কে বিস্তরিত জানতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বই, উপন্যাস, কবিতা এবং যে সব বুদ্ধিজীবী, কবি ও সাহিত্যিক মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক, উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ এবং বিখ্যাত গান সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হবে। আপনাকে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের প্রাণের স্পন্দন, তাই এ বিষয়টিকে কোনো ভাবেই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
৬) বাংলাদেশের অর্থনীতি
দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যেহেতু আপনাকে দেওয়া হবে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে জানা আপনার জন্য একান্ত জরুরি। দেশের বাজেট, জিডিপি সম্পর্কে জানতে হবে। এক্ষেত্রে আপনাকে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং সমৃদ্ধ সম্পর্কেও বিস্তরিত জানতে হবে। অন্যদিকে বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে কী কী অবদান রাখছেন সে সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে জানতে হবে। এছাড়াও ২০২১ সাল এবং ২০৪১ সালের রুপরেখা সম্পর্কে ধারণা রাখা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ তা জানতে হবে।
৭) সংবিধান ও মানচিত্র
শুধু ভাইভা জন্য নয় একজন সু-নাগরিক হিসেবেও সংবিধান সম্পর্কে জানা একান্ত জরুরি। এক্ষেত্রে আপনাকে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো জেনে নিতে হবে। এছাড়াও আপনার পছন্দক্রমের সাথে মিল রেখেও সংবিধানের বিশেষ বিশেষ ধারাগুলো সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। কোনো দেশের পরিচিতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে মানচিত্র জানা খুবই জরুরি।
৮) ভাষা হিসেবে ইংরেজি
অনেক ক্ষেত্রে ভাইভায় ইংরেজিতে প্রশ্ন করা হয়। আর ইংরেজিতে প্রশ্ন করা হলে আপনাকে অবশ্যই ইংরেজিতে উত্তর দিতে হবে। তাই আগে থেকে যদি ইংরেজিতে কথা বলা শিখে নেন তাহলে ভাইভাতে ভালো করতে পারবেন।
৯) দেশের বিখ্যাত ব্যক্তি, কবি এবং সাহিত্যিক
প্রথমেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর সহমান সম্পর্কে বিস্তরিত জেনে নিতে হবে। এছাড়াও বিখ্যাত কবি, সহিত্যিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মুধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মীর মোশাররফ হোসেন, প্রমথ চৌধুরী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশ, রাজা রামমোহন রায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুফিয়া কামাল, হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ূন আজাদ, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, সেলিম আল দীন, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত ওসমান, জহির রায়হান, জসীমউদ্দিন এবং সেলিনা হোসেন সম্পর্কেও জানতে হবে। এছাড়াও এসব সাহিত্যিকদের জীবনী, সাহিত্য কর্ম এবং তাদের বিখ্যাত উক্তি ভালোভবে পড়ে নিতে হবে।
১০) মনোযোগ দিয়ে শুনুন
পরীক্ষকের প্রশ্ন মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। শুনার পর একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে উত্তর দিতে হবে। উত্তর দেওয়ার সময় আপনার জানা বিষয় দিয়ে উত্তর দিবেন। (দ্বিতীয় অংশটি সংগৃহীত)
পড়ুন: বিসিএস ভাইভার জন্য ‘বিশেষ পরামর্শ’
পড়ুন: ভাইভা পাসে আয়নার সামনে দাঁড়ান, চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শিখুন