ম্যাজিস্ট্রেট হাবিবা: শেষ বিসিএসই যার প্রথম বিসিএস!

ছোট থেকে চাকরি করার তেমন ইচ্ছে ছিল না তার। বড় হয়ে সবাই যেমন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন সেরকম কোনো স্বপ্নও ছিল না। তবে বিয়ের পর স্বামী, সংসার, সন্তান নিয়ে জীবনটা একঘেয়ে লাগছিলো। এরই মাঝে বিষয়টা স্বামীকে জানালে তিনি দুষ্টুমির ছলে বলেছিলেন, ‘চাকরি করতে চাইলে বিসিএস দাও।’

স্বামীর সেই কথাই যেনো তার জীবনের অনুপ্রেরণা হয়ে আসে। জীবনের শেষ বিসিএসেই সফল হন তিনি। বর্তমানে কর্মরত আছেন চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে।

তিনি উম্মে হাবিবা মীরা। তার এই সফলতার গল্পটা মোটেও সহজ নয়। মীরার এই সাফল্যের গল্পটা শুনতে আমাদের ফিরে যেতে হবে একটু পেছনে।

কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় জন্ম মীরার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মীরা চতুর্থ। মা উম্মে আতিয়া ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। আর বাবা আলাউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ইনকাম ট্যাক্স কর্মকর্তা। লেখাপড়ার ভিত্তিটা মায়ের হাত গড়া বলেই তাতে কোনো ঘাটতি ছিল না।

ছোট থেকেই লেখাপড়ায় ছিলেন মেধাবী। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পেয়েছেন মেধাবৃত্তি। ২০০০ সালে এসএসসি ও ২০০২ সালে এইচএসসিতে পেয়েছেন প্রথম বিভাগ। অনার্স মাস্টার্স করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্নতত্ত্ব বিভাগে।

লেখাপড়া শেষ করে ২০১০ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের ট্রেইনার, সাবেক ক্রিকেটার ও বিকেএসপির ক্যাডেট মোরশেদ হাসান সিজারের সাথে। শুরু হয় সংসার। শ্বশুরবাড়ির সবার চোখের মনি হয়ে যান অচিরেই। মীরার শ্বাশুড়ি ছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা। মীরার জা (ভাশুরের স্ত্রী) ও ছিলেন চাকরিজীবি। বিয়ের পর পরই স্বামী মোরশেদ হাসান চাকরির সুবাদে বিদেশ ট্যুরে ব্যস্ত থাকায় বেশ একাকীত্বে ভুগছিলেন মীরা। এর মাঝেই মীরার কোল আলো করে আসে তাদের একমাত্র সন্তান উম্মে আন-নাফি। নাফির বয়স যখন প্রায় ৪ মাস তখনই মীরা তার স্বামীর কাছে জানান চাকরির প্রতি আগ্রহের বিষয়টা।

স্বামী মোরশেদ হাসান সেদিন দুষ্টুমি করে মীরাকে বিসিএসের কথা বললেও মীরা একাগ্রতা ও মনোযোগ দিয়ে শুরু করেন বিসিএসের প্রস্তুতি। মীরার বয়স তখন ৩০ হতে আর অল্প বাকি। সেই বিসিএসই ছিলো তার জীবনের প্রথম ও শেষ বিসিএস।

শুরু হয় মীরার জীবনের সংগ্রাম। এতদিন জীবনটা বেশ মসৃণ হলেও বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে মীরাকে করতে হয়েছে উদয়াস্ত পরিশ্রম।

মীরার লেখাপড়া শুরু হতো রাত এগারোটায়। তার ছোট্ট মেয়েটি ঘুমানোর পর। পড়ালেখা চলতো ফজরের আযান পর্যন্ত। তারপর নামাজ পড়ে ঘুমোতে যেতেন তিনি। ঘুমোতেন ঠিক নয়টা পর্যন্ত। মেয়ে ঘুম থেকে ওঠার আগ পর্যন্ত। তারপর শুরু হত তার কর্মব্যস্ত গৃহিণীর কাজ। সংসার-সন্তান সবদিক সামলেছেন নিপুণ হাতে। তবে এক্ষেত্রে শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামী সিজারের সহযোগিতার বিষয়টি বারবার স্মরণ করেছেন মীরা।

অবশেষে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল পান মীরা। ৩৪তম বিসিএসের মাধ্যমে যোগ দেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে। বর্তমানে কর্মরত আছেন চাঁদপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। এ ক্ষেত্রেও সফল মীরা। সুচারুরুপে পালন করে চলেছেন তার উপর অর্পিত দায়িত্ব। অবলীলায় করে ফেলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ চ্যালেঞ্জিং সব কাজ।

বিসিএস দিতে যারা আগ্রহী তাদের উদ্দেশে প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তা বলেন: প্রত্যেকটা মানুষের পড়ালেখার আলাদা কৌশল থাকে। কেউ পড়ে বেশি মনে রাখতে পারে। কেউবা আবার লিখে বেশি মনে রাখতে পারে। যার যেভাবে মনে থাকে সে সেভাবেই পড়বে। তবে সেক্ষেত্রে নিয়মতান্ত্রিকতা খুব জরুরি বলে মনে করেন মীরা। একদিন ১০ ঘণ্টা পড়ে পরে দু’দিন না পড়লে তার কোনো মূল্য নেই। আর যেহেতু এটা একটা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা কাজেই যারা এ বিষয়ে বেশি সময় দেবে তারাই প্রতিযাগিতায় টিকে থাকবে।

প্রতিটি বিষয় সমান গুরুত্ব দিয়ে পড়া উচিত উল্লেখ করে মীরা বলেন: বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান প্রতিটি বিষয়ই ধরে ধরে পড়তে হবে। তবে অংকে যেহেতু সলিড নম্বর; কাজেই এ বিষয়ে একটু বেশি সময় দেয়া প্রয়োজন।

লিখিত পরীক্ষায় সফল হতে হলে তথ্যবহুল লেখা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। মীরা বলেন, একপাতা লিখে ভরিয়ে ফেললাম কিন্তু সেখানে কোনো তথ্য নেই; তাতে লাভ হবে না। বরং তিন লাইন লিখেও যদি প্রতিটি লাইনেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়া যায় তাহলেই নম্বর বেশি পাওয়া যাবে।

মীরা বিশ্বাস করেন, কোনো বিষয়ের প্রতি একাগ্রতা, আল্লাহর রহমত এবং নিকটজনদের সহযোগিতা থাকলে সফলতা আসবেই।

আরো পড়ুন: বাবার সম্মান রক্ষায় ক্যাডার হয়েছি: লিখেছেন এএসপি দিদার নূর


সর্বশেষ সংবাদ