বারবার ছুটি বৃদ্ধি, পড়াশোনায় অনীহা বাড়ছে

করোনায় দেশে চলমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী
করোনায় দেশে চলমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী  © টিডিসি ফটো

করোনা মহামারীর প্রকোপ সামলে দেশের অর্থনৈতির খাতগুলো সচল হলেও দেশের শিক্ষাখাতে এখনো রয়েছে ব্যাপক অনিশ্চয়তা। দীর্ঘ দেড় বছরেরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন বা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরার এ অনিশ্চয়তা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে দেখা দিচ্ছে হতাশাসহ আত্মহত্যার মতো ঘটনাও।

অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম এবং দফায় দফায় ছুটি বৃদ্ধি নিয়ে শিক্ষার্থীদর বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিনিধি— সাদিয়া তানজিলা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী বেনজীর ফেরদৌসী বলেন, বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়। দেশের দূর্বল নেট কানেকশন, উপযুক্ত ডিভাইসের সংকট এসব সাধারণ সমস্যা। বারবার নেটওয়ার্ক সমস্যায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে যেমন মনোযোগসহ ক্লাস করা ব্যহত হয় তেমনি দীর্ঘক্ষণ স্ক্রীনে তাকিয়ে, কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ক্লাস করায় শারীরিক ক্লান্তিসহ চোখ ব্যথা, মাথাব্যথার মতো শারীরিক সমস্যাগুলো দেখা দিচ্ছে।

তিনি বলেন, করোনার প্রভাবে শিক্ষব্যবস্থায় সবাই ভুক্তভোগী। বিশেষ করে অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য এ সময়টা অভিশপ্ত বলতেই হবে। অফলাইন ক্লাসে নিজেদের বিভাগের গাদা গাদা ইংরেজি বইয়ে অভ্যস্ত হতে না হতেই অনলাইন ক্লাসের নেতিবাচক অভিজ্ঞতা। সেই সাথে ২ বছরের বিরতিতে সেশনজটের ভোগান্তির সম্ভাবনা প্রকট।

বারবার ছুটি বৃদ্ধির নেতিবাচক দিক উল্লেখ করে ফেরদৌসী বলেন, দফায় দফায় ছুটি বৃদ্ধিতে স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরে অফলাইনে ক্লাস করতে যত বিলম্ব হচ্ছে ততই শিক্ষার্থীদের হতাশা বাড়ছে। ছুটি বৃদ্ধিতে একাডেমিক পড়াশোনার প্রতিও অনীহা বেড়ে গেছে। দুবছরের পড়াশোনার ঘাটতি পূরণ নিয়ে সবাই শঙ্কিত। করোনায় নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু দেখে, দিনের বেশির ভাগ সময়টা চার দেওয়ালের মাঝে কাটিয়ে অনেকের মানসিক সমস্যা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা লকডাউনে তাই আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে আত্মহত্যার মতো ঘটনা।

মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভাসিটির সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী দিয়াত মাহমুদ শাকিল বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেকটা শিক্ষা কার্যক্রম থেকে দূরে সরে এসেছি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা অবস্থায় দিনের একটা বড় সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পড়াশোনার মধ্য দিয়ে কাটাতাম। এখন সেই সময়টা বাড়িতে শুয়ে বসে কাটাতে হচ্ছে।

শাকিল বলেন, অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের পরবর্তী জীবনে খুব একটা সুফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করিনা। কেননা অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থার কতগুলো সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভার্চুয়াল জগতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বাস্তবতাকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে না পারা। সুতরাং চলমান অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা একটি অভিশাপ বলে আমি মনে করি। এছাড়া দফায় দফায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধির ফলে বিষন্নতা, উদ্বেগ আর মানসিক চাপ ছাড়াও অতিরাগ, জেদ ও একাকিত্বে ভুগছি। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমার সামাজীকরন। অস্বাভাবিক মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী ক্রমেই পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে।

ঢাকা ইন্টান্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আল মামুন সোহাগ বলেন, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম সচল থাকলেও এখনো সেভাবে এ শিক্ষার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিনা। অনলাইন ক্লাস বা পরীক্ষা দিয়ে শুধু শিক্ষাবর্ষ অতিক্রম করা গেলেও, বাস্তবজীবনে তা কতোটা কাজে লাগবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এছাড়া অনলাইন শিক্ষা কখনোই বাস্তবিক জ্ঞানের পরিপূরক হতে পারেনা। এছাড়া টানা ৩/৪ ঘন্টা অনলাইনে ক্লাস করে আমরা মানুষিক এবং শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

মামুন সোহাগ বলেন, গার্মেন্সকর্মী, বাসচালক বা দোকানে যারা কাজ করেন তাদের থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিজেদের স্বাস্থ্য সচেতন এবং অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। তাই এভাবে সবকিছু খুলে রেখে শুধুমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাটা কোনো মতেই যুক্তি সংগত হতে পারে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকারের ভিক্তিতে টিকার আওতায় এনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হোক।

জাতীয় বিশ্বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ফাল্গুনী সাহা পূর্ণিমা বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা অধিকাংশ শিক্ষার্থীই লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। ফলে শিক্ষা গ্রহণের যে আগ্রহ তা ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বিশাল এক ছন্দপতন ঘটেছে জীবনের। এরমধ্যে পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় বা পরীক্ষা ছাড়া আমাদের যে মূল্যায়ন হচ্ছে এবং পরবর্তী বর্ষে তুলে দেওয়া হচ্ছে এটা আমাদের ভবিষ্যতকে আরো বেশি অনিশ্চিত করে তুলছে।

ফাল্গুনী বলেন, নিজেকে বা নিজের মেধা দক্ষতা যাচাইয়ের যে ধারাবাহিকতা ছিল; পরীক্ষা না থাকায় তা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ধাপে ধাপে এভাবে ছুটি বৃদ্ধি এই বিষয়টা আমাদের মাঝে আরো বেশি হতাশা সৃষ্টি করছে। আমরা মানুষিকভাবে ভেঙে পড়ছি। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে ঝরে পড়ছে। একদিকে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ অন্যদিকে খোলারও কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজা জাহান তান্নি বলেন, ইউনিসেফের তথ্যানুসারে করোনার কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে বাংলাদেশ। প্রায় দেড় বছর পার হয়ে গেছে আমরা সশরীরে ক্লাসে ফিরতে পারিনি।

খাদিজা বলেন, প্রথমত অনলাইন ক্লাস ছিলো আমাদের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা অন্যদিকে নেটওয়ার্ক স্লো, যান্ত্রিক জটিলতা, ডিজিটাল ডিভাইসের সল্পতা সব মিলিয়ে অপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা অগ্রগতির পেছনে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নামকাওয়াস্তে অনলাইন ক্লাস, এসাইনমেন্ট, অটোপাসের মাধ্যমে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা চলমান থাকলেও শিক্ষার্থীদের জীবনে ঠিক কতটা সুফল বয়ে আনছে কিংবা আনবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমীদ খান বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পড়া লেখার ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে না। প্রবাদে আছে- ‘বন্যরা বনে সুন্দর আর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। পড়া লেখার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই উত্তম। বাসায় বসে কখনোই সঠিক শিক্ষা পাওয়া যায় না। তাই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা সংকটপূর্ণ সময়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও তা দীর্ঘময়াদী না হওয়াই শ্রেয়।

তাহমীদ বলেন, অনলাইন ক্লাসগুলোতে গ্রামাঞ্চলের অনেকেই সংযুক্ত হতে পারছে না। এতে তাদের জানার পরিধি স্বল্প হয়ে যাচ্ছে। পরীক্ষায় ভালো মত অংশগ্রহণ করতে পারছে না। এতে উচ্চশিক্ষায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। দফায় দফায় ছুটি বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেকেরই মনোবল ভেঙে পড়ছে। মানুষিকভাবে অসুস্থ, হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। এসব শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস শূন্যে নেমে যাচ্ছে। সামাজিক ও মানসিক চাপে আত্মহত্যা করছে এবং ঝরে পড়ছে অনেক শিক্ষার্থী।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence