প্রাণের ক্যাম্পাসে আর ফেরা হবে না ওদের

করোনাকালে মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শিক্ষার্থীর
করোনাকালে মৃত্যু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শিক্ষার্থীর  © টিডিসি ফটো

করোনা টিকা দিয়ে কিছুদিন পরই খুলে দেওয়া হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আবাসিক হল। এরপর সশারীরে চলবে ক্লাস-পরীক্ষা। করোনার প্রাদুর্ভাবে প্রায় দেড় বছর পর শিক্ষার্থীরা তাদের প্রাণের ক্যাম্পাসে ফিরবে। তারপর ক্লাস, আড্ডা, বন্ধুদের হুল্লোড়— যেন প্রাণ ফিরে পাবে সেই চিরচেনা ক্যাম্পাসে। বন্ধুকে কাছে পেয়ে সেকি উচ্ছ্বাসে মাতবে তারা।

তবে চিরচেনা সেই ক্যাম্পাসে আর ফেরা হবে না বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ শিক্ষার্থী। জানা গেছে, গত বছরের মার্চ থেকে দেশে করোনা সংক্রমণের পর থেকে এসব শিক্ষার্থী পৃথিবী থেকে চিরবিদায় জানিয়েছেন। এর মধ্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন সাতজন। আর বিভিন্ন রূগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনজন।

সর্বশেষ রবিবার সকালে রাজধানীর আজিমপুর সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের বাথরুমের দরজা ভেঙে মরদেহ উদ্ধার করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান তুষ্টিকে। তিনি ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ থাকায় আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টার্সের ১৮ নম্বর ভবনের নিচতলায় এক বান্ধবীর সঙ্গে থাকছিলেন তুষ্টি। তার অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল। সেখান থেকে মৃত্যু হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণ করা হচ্ছে।

গত ১৫ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমান মারা গেছেন। ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় তার তিন বন্ধু এলএসডি সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টস পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে তিনি নিজের গলায় আঘাত করেন।

সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঘটনার দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ৯টা ৪০ মিনিটে অজ্ঞাতনামা হিসেবে তার মৃত্যু হয়। গত ২৩ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে হাফিজুরের ভাই তার লাশ শনাক্ত করেন।

গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর সকালে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম সিয়াম আত্মহত্যা করেন। ঘটনার দিন সকালে ওই ছাত্র নিজের বাসায় ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।

আগামী সপ্তাহে টিকাদান শুরু হলে আগস্টে খুলবে বিশ্ববিদ্যালয়

১৭ আগস্ট নিজ বাড়িতে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ইমাম হোসাইন নামের এক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। এর আগে ফেসবুকে তিনি ‘আল-বিদা’ লিখে স্ট্যাটাস দেন ওই শিক্ষার্থী। তার বন্ধুরা জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে হতাশায় ভুগছিলেন। জানা গেছে, ইমাম হোসাইনের বাড়ি বরিশাল জেলার উজিরপুর থানায়।

পছন্দের ছেলেকে বাদ দিয়ে অন্যের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ায় গত ২৬ অক্টোবর আত্মহত্যা করেন ঢাবির ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী ফারিহা তাবাসসুম রুম্পা। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে পড়ুয়া রুম্পার গ্রামের বাড়ি পাবনা জেলার ঈশ্বরদী থানাধীন দীঘায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হলের আবাসিক ছাত্রী তিনি।

তীব্র বিষন্নতা ও মানসিক চাপ থেকেই আত্মহত্যার পথ বেঁচে নেন ঢাবির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শুভজ্যোতি মন্ডল (২২)। গত ১৪ অক্টোবর বিকেলে সংবাদ পেয়ে আদাবর মোহাম্মদীয়া হাউজিং সোসাইটির ৪ নম্বর রোডের ১৪১ নম্বর বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত শুভজ্যোতি ঢাবির চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন।

২২ জুন শ্বশুরবাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সুমাইয়া খাতুনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সুমাইয়া নাটোর সদরের হরিশপুর বাগানবাড়ি এলাকার মোস্তাক হোসাইনের স্ত্রী। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের এ শিক্ষার্থী মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে ফলাফলের অপেক্ষমান ছিলেন। এসময়ের মধ্যে তিনি বিসিএস ও সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বলে জানা গেছে।

গত বছরের ৬ এপ্রিল বিনা চিকিৎসাতেই মৃত্যু সুমন চাকমার। তিনি ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। শিক্ষা ও গবেষণা অনুষদের ২২তম ব্যাচের ছাত্র সুমন জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন। এর আগে ২৬ মার্চ সুমন চাকমা ফেসবুকে কিছুটা হেয়ালি করেই লিখেছিলেন, ‘আমার করোনা হয়নি, অথচ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে হয়তো করোনায় আমার মৃত্যু হতে পারে।’

অবশেষে হেয়ালি থেকে তার সে লেখাই সত্য হয়েছে। তবে করোনা অক্রান্ত হয়ে নয়, ক্যান্সারে আক্রান্ত এই শিক্ষার্থী বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে গেলেও করোনাভাইরাসের ভয়ে তাকে চিকিৎসা দেয়নি কোনো হাসপাতাল।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) শরিফুল ইসলাম শাকিল মারা গেছেন। তিনি ২০১৩-১৪ সেশনের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। এর আগে গত ২৮ আগস্ট থেকে গুরুতর অসুস্থ হয়ে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিল। শাকিলের হার্ট ও মস্তিস্কের জটিলতা ছিল।

মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত বছরের ৩ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফজলে রাব্বী মারা গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (আইএলইটি) ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের এই ছাত্র বোনম্যারো ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন ছিলেন ফজলে রাব্বী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি এ রোগের সঙ্গে লড়ে অবশেষে মারা গেছেন।


সর্বশেষ সংবাদ