‘আপনার স্বামী আর্মিতে, আমার স্ত্রীও ডাক্তার— চলেন পরকীয়া করি’
ছাত্রীকে ঢাবি শিক্ষক
- মুহাইমিনুল ইসলাম, ঢাবি
- প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:২৬ PM , আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:১৪ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যাংকিং এন্ড ইনসুরেন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খালেদ বিন আমিরের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে হেনস্তা, কুৎসা রটানো, অপেশাদার আচরণসহ নানা অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরকীয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে তাকে শিক্ষকতার পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে আন্দোলনে রয়েছেন বিভাগটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এছাড়া স্মারকলিপির দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের।
স্মারকলিপিতে বিভাগটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছে—শিক্ষক খালেদ বিন আমির বিশ্ববিদ্যালয় বহির্ভূত নারী কেলেঙ্কারি, অনুষদের অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের হেনস্তা, বিভাগের নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা, অযাচিত কটূক্তি, বিভাগের নারী সহকর্মীর নামে ছাত্রদের সামনে কটূক্তি, সহকর্মীদের নামে কুৎসা রটানো, পাঠদানে অপারগতা, অপেশাদার আচরণ করেছেন। ইতোমধ্যে এই বিষয়ক যথেষ্ট প্রমাণাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব অপরাধের দায়ে শিক্ষকতার পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, আমরা বিভাগে অভিযোগ প্রমানাদিসহ ২৭ আগস্ট স্মারকলিপি দিয়েছিলাম। এর আগে ২৫ আগস্ট বিভাগকে ৩ কার্যদিবসের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছিল অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তারপর ২৮ আগস্ট থেকে অভিযুক্তের পদত্যাগের দাবিতে আমরা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিই।
আরও পড়ুন: ঢাবিতে কি শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই ‘নোটেবল অ্যালামনাই’?
‘‘আমরা এই কর্মসূচি ২ দিন পালন করি। এরপর ৩১ আগস্ট পুনরায় অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা বিভাগ ঘেরাও ও অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেই। ওইদিন আমরা বিভাগ থেকে কেনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না সেই মর্মে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। তখন সেখানে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সহকারী প্রক্টর। তারা ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগগুলো নিয়ে কাজ করার আশ্বাস দেন। তবে ৭ দিন পার হয়ে গেলেও তার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আগামী ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হলে তারা ফের আন্দোলন করবেন বলে জানিয়েছে।’’
বিভাগটির সাবেক এক নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার প্রমাণাদি রয়েছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে। বর্তমানে তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
পরকীয়ার প্রস্তাবে ওই ছাত্রীকে খালেদ বিন আমির তখন বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক থাকাকালীন তিনি আমার সাথে এবং অন্যান্য অনেক সিনিয়রদের সাথে একই কাজ করেছিলেন। সেজন্য আমার তাঁকে ব্লক করতে হয়েছিল। ‘‘তিনি বলতেন—আপনার স্বামী তো আর্মি তে, ওরা তো টাইম দিতে পারে না, আমার বউও ডাক্তার, আমাকে টাইম দিতে পার না।’’ তিনি প্রায় সরাসরি আমাকে পরকীয়া এবং সাক্ষাতের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। অসহ্য লোক একটা।’
আরও পড়ুন: আ’লীগ সিন্ডিকেটের কর্মকর্তাকে মাউশিতে ‘প্রাইজ পোস্টিং’, শিক্ষা ক্যাডারে ক্ষোভ
বিভাগ তথ্য বলছে, শিক্ষার্থীদের অশালীন মন্তব্য করে বিব্রত করাই যেন ঢাবির এই শিক্ষকের কাজ। বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের তার কাছে বিব্রত হতে হয় ব্যাপকভাবে।
এ নিয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিভাগটির এক ছাত্রী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একদিন খালেদ বিন আমির স্যার অনলাইনে বিজনেস ম্যাথের এক ক্লাসে শিক্ষার্থীদেরকে ক্যামেরা অন করতে বলেন। একেবারে ভোরে ক্লাস হওয়াতে শিক্ষার্থীরা অপ্রস্তুত থাকায় অনেকেই ক্যামেরা অন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে ড. আমির মন্তব্য করে বসেন, ‘তোরা কীভাবে ক্যামেরা অন করবি, তোরা তো কম্বলের নিচে নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকিস।’ ফলে সেই দিনের ক্লাসে অধিকাংশ নারী শিক্ষার্থী লিভ নিতে বাধ্য হন।
এছাড়া তার কবল থেকে রক্ষা পায়নি ধর্মীয় কারণে পর্দা করা নারী শিক্ষার্থীরাও। পর্দা করে আসা এক নারী শিক্ষার্থীকে তিনি বলেন, পর্দা করছেন কিন্তু আপনার বয়ফ্রেন্ড কি জানে? আপনি কি বয়ফ্রেন্ডকে দেখানোর জন্য পর্দা করেছেন! আমি তো জানি টিএসসি তে আপনারা পর্দাও করেন। আবার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কি কি যেন করেন। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন।
আরও পড়ুন: উত্তাল বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, চলছে ‘উত্তরবঙ্গ ব্লকেড’ কর্মসূচি
এছাড়াও বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্র বলেন, খালেদ বিন আমির স্যার তো ওনার ওয়াইফ নিয়েও বাজে মন্তব্য করতে পিছপা হননি। উনি উনার স্ত্রীকে নিয়েও ক্লাসে বাজে মন্তব্য করেন। উনি বলেন, উনার ওয়াইফ নাকি অনেক বোরিং। তার চাইতে ওনার এক্স গার্লফ্রেন্ড অনেক ভালো ছিল। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ ব্যবহার এবং ফেল করানোর ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে চলতি মাসের ১ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং এন্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা তার চাকুরিচ্যুতির দাবিতে ব্যাপক মিছিল এবং শোডাউন করে।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. সাইফুদ্দিন আহমেদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে স্মারকলিপি জমা দিলে আমরা চেয়ারম্যানকে অবগত করব সমাধান করার জন্য। চেয়ারম্যান বিষয়টি সমাধান করতে না পারলে ডিন মহোদয়কে আমরা জানাবো। সেখানে আমরা একটা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠন করব, সেখানে থাকবে আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং প্রক্টরিয়াল টিমের একজন সদস্য। এর পরেও না হলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের নিকট স্মারকলিপি হস্তান্তর করবো।
আরও পড়ুন: প্রশাসন ভবন খালি, কর্মকর্তারা ব্যস্ত আমবাগানের দাবা—লুডুর বোর্ডে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকিং এন্ড ইনসুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাসিনা শেখ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা শিক্ষকরা সবাই মিলে ছাত্রদের বক্তব্য শুনেছি। তাদের বুঝিয়েছি যে বিভাগীয় পর্যায়ে একজন শিক্ষকের ‘পদত্যাগ’ আমাদের সামর্থ্যের বাইরে। শিক্ষার্থীরা তখন সহায়ক নথিসহ আমাদের আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠায়। আমরা আমাদের সমন্বয় ও উন্নয়ন কমিটিতে আলোচনা করেছি এবং মাননীয় ভিসি স্যারের কাছে পাঠিয়েছি।
যা হোক, প্রক্টর স্যারের নির্দেশে, আমরা শিক্ষার্থীদের সাথে আরেকটি বৈঠকের ব্যবস্থা করেছি যেখানে আমাদের অনুষদের ডিন স্যার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ স্যার আমাদের শিক্ষকদের সামনে শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গঠনের আশা নিয়ে সভা শেষ হয়। অবশেষে, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে একটি কমিটি গঠন করা হয় যাতে এই ধরনের তদন্তের সময় শিক্ষককে কোনো একাডেমিক বা প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়—জানান অধ্যাপক ড. হাসিনা শেখ।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক খালিদ বিন আমিরের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।