হাসিনার পতনের দিন ৫ আগস্ট ঢাবি ক্যাম্পাস যেমন ছিল

ঢাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থিীদের বিক্ষোভ মিছিল
ঢাবি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থিীদের বিক্ষোভ মিছিল  © সংগৃহীত

চলতি বছরের ৪ আগস্ট শাহবাগ থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে ঘোষণা এলো সারাদেশের মানুষের উদ্দেশ্যে যে ৬ আগস্ট লং মার্চ ঢাকা কর্মসূচি সফল করতে হবে। কিন্তু ঐদিন সারাদেশে একদিনে সর্বাধিক মানুষ মারা যাওয়ায় সেদিন রাতেই আবার ঘোষণা এল ৬ আগস্ট নয় পরের দিন অর্থাৎ ৫ আগস্টই লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। সারাদেশ থেকে ঢাকায় মানুষকে আহ্বান করা হলো।

এর  আগেই অবশ্য সারাদেশে শেখ হাসিনাকে খুনি ও স্বৈরাচার বলে তার পতনের দাবিতে ১ দফা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলো ছাত্র জনতা। ১ আগস্ট ঢাবি ক্যাম্পাস সংলগ্ন শহিদ মিনারে লাখ লাখ মানুষ একত্রিত হয়। ২ তারিখও প্রচুর মানুষের জমায়েত হয়। সারাদেশে প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটলে ঐদিন রাতেই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ১ দফা ঘোষণা দেওয়া হয়। এক দফার পক্ষে ফেসবুকে পোস্ট করেন হাসনাত, সারজিস সহ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।

৩ তারিখ সারাদেশে সমাবেশ হয়, ৪ তারিখ সারাদেশে প্রচুর মানুষ নিহত ও আহত হয় এবং লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি একদিন এগিয়ে ৫ তারিখ করা হয়। গণভবন ঘেরাও হবে এমন একটি বার্তা ছড়িয়ে যায়।  ৪ তারিখ দিবাগত রাতটি ছিল খুবই দীর্ঘ মানুষের কাছে। এদিকে রাতভর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রাতভর বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে ভীতিসঞ্চার করে শিক্ষার্থীদের মাঝে। 

148993_126

৫ তারিখ সকাল হলেই কী জানি হয় এমন একটি মনোভাব নিয়েই রাত জেগে ছিল ছাত্র জনতা। সমন্বয়করা বারবার ফেসবুক পোস্ট করে জনগণকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানাচ্ছিলেন। জনমনেও একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে ৫ তারিখই শেখ হাসিনার পতন হবে।

৫ই আগস্ট ঢাবি ক্যাম্পাস যেমন ছিল

সকাল থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো। টিএসসিতে তখনও ২০ জন সাংবাদিক বসেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতিতে। পর্যবেক্ষণ করছিলেন তারা সব কিছু। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ধরে রাখতে মরিয়া ছিল শেখ হাসিনা। সকল ১০টার দিকে কয়েকশত শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হলে তাদের উপর গুলি চালায় পুলিশ, টিয়ারশেল সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে তাদেরকে ছত্র ভঙ্গ করে দেয়। এছাড়াও  চানখারপুল এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কয়েকজন আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে গুলিও চালায়। 

1722856117_1

ততক্ষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশের পাশের এলাকা পুরো পুলিশ-বিজিবির দখলে। তবে পলাশী মোড়ে কয়েকশ শিক্ষার্থীরা মিছিল বের করে আন্দোলন করছিলো। পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। 

ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই পূর্বঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ র‍্যালি বের করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দল। পুলিশের ভয়ে শিক্ষকদের পেছনে দাঁড়িয়ে যায় কিছু শিক্ষার্থী। তাদেরকে নিরাপত্তা দেয় সাদা দলের শিক্ষকরা।  কিছুক্ষণ পরেই ঘোষণা আসে সেনা প্রধান দুপুর ২ টায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। তখনই মানুষ বুঝে গিয়েছিলো শেখ হাসিনার পতনের বিষয়টি। 

image-28795-1722835649

পুলিশ ও বিজিবি দ্রুত তাদের স্থান ত্যাগ করে। দুপুর ১ টা বা তার কিছুক্ষণের মধ্যেই টিএসসি শাহবাগে লাখো মানুষের ঢল নামে। সারাদেশে মুহূর্তের মধ্যেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ২ টা বাজে নেট সচল করলে মানুষ জানতে পারে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। এটি শোনার পর পরই মানুষ উল্লাসে মেতে ওঠে। ঢল নামে মানুষের। গণভবনে ঢুকে পড়ে মানুষ।   এভাবেই সারাদেশে এক নাটকীয় গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতন হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেদিনের পরিস্থিতি যেন কিছুক্ষণ পরপর বদলে যাচ্ছিলো।

৫ আগস্ট পরবর্তী এক মাস ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নানা পদক্ষেপ ও কার্যাবলী

শেখ হাসিনার পতনের পরপরই সারাদেশে শুরু হয় আনন্দ উৎসব। শতশত আনন্দ মিছিল বের হয় সারাদেশের রাস্তায়। গণভবন দখল করে সাধারণ জনতা। কিন্তু এর একদিন পর শুরু হয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর হামলা। তাদের মধ্যে অনেকে জুলাই হত্যাকান্ডে জড়িত। 

4ca723c3e15fd321456ae7724f8265f73cbb6e1976f5799d

 

আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িত এমন কিছু হিন্দুদের বাড়িতে হামলা হয়। পুলিশের অনুপস্থিতে কয়েকটি জায়গায় লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এসবের প্রেক্ষিতে ৬ তারিখ রাতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বায়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ ও আবু বাকের মজুমদার এক ভিডিও বার্তায় ছাত্র জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান এবং ড. ইউনুসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি রূপরেখা তারা জানিয়ে দেন। এদিন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৩ জনের টিম রাষ্ট্রপতি ও তিন বাহিনীর প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

৭ তারিখ সারাদেশে মন্দিরে হামলার ঘটনায় মন্দির পাহারা দেয় মুসলিম ছাত্র জনতা। এদিন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ একটি ঘোষণা দেন। সেটি হলো, ❝ছাত্র-জনতার এই গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মেরামত করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ সাধন করার জন্য। গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হবে ছাত্র নাগরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করা। কোন নির্দিষ্ট দল কিংবা গোষ্ঠীর ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য নয় ছাত্র-জনতার প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা ও দাবি অনুযায়ী রাষ্ট্র মেরামত না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র-জনতা সতর্ক ও সজাগ আছে এবং থাকবে।  যেকোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উসকানি, জনগণের সম্পত্তির ক্ষতি সাধন ও বিশৃঙ্খলা প্রতিহত করতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত আছে ও জনগণের সাথে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধ করেছি আমরা, এখন আবার দায়িত্ব নিয়ে সেই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতিও নিরাময় করছি। ❞

17229583201742024-08-06_213035

৮ ও ৯ তারিখ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় এবং শপথ গ্রহণ করে। এদিন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একাংশ বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করে। এদিন থেকে রাস্তায় রাস্তায় স্বেচ্ছায় ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিলো শিক্ষার্থীরা। ১০ তারিখ একটি বিচার বিভাগীয় ক্যু এর শঙ্কা দেখা দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হাইকোর্ট ঘেরাও করে এতে করে বাধ্য হয়ে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করে।

১১, ১২ ও ১৩ তারিখ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিভিন্ন মেডিকেলে যায়। এবং ১২ তারিখ বিকেল ৪ টায় শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে টিএসসি তে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। ১৩ তারিখ প্রতিবিপ্লব রুখতে সপ্তাহ ব্যাপী ❝প্রতিরোধ সপ্তাহ❞ কর্মসূচি শুরু করা হয় রোড মার্চ দিয়ে। ১৪ তারিখ শাহবাগে ইনকিলাব মঞ্চের আয়োজনে একটি সমাবেশ করা হয় এবং প্রতিরোধ সপ্তাহের অংশ হিসেবে আন্দোলনে শহিদদের স্মরণে শাহবাগ থেকে ধানমন্ডির রাপা প্লাজা পর্যন্ত পদযাত্রা করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ১৪ তারিখ রাত ও ১৫ তারিখ সারাদিন শিক্ষার্থীরা রাজপথে থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী পালনে জনগণকে ধানমন্ডি সহ সকল স্থানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে বাধা প্রদান করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে শিক্ষার্থী সাউন্ড বক্স বাজিয়ে আনন্দ করে। এদিন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতি বিপ্লবের আশঙ্কায় সর্বাত্মক অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করে।  ২০ আগস্ট পর্যন্ত ❝প্রতিরোধ সপ্তাহের কর্মসূচি চলে এবং নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।  স্ট্যন্ড উইথ দ্যা ইনজুরডসহ বিভিন্ন নামে তারা কর্মসূচি পালন করে। 

6573_TSC-udyognews

২১ তারিখ থেকে শুরু হয় ভারত থেকে আসা উজানের পানিতে বাংলাদেশের নতুন সমস্যা, সেটি হলো ভয়াবহ বন্যা। এসময় শুরু হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফান্ড কালেকশন। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচি।  দীর্ঘদিন ফান্ড কালেকশনে ১১ কোটির বেশি টাকা নগদ অর্থ এবং কোটি কোটি টাকার ত্রাণ সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন।  অবশেষে গতকাল তাদের ফান্ড কালেকশন ও ত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়। 

গণঅভ্যুত্থানের একমাস পূর্তিতে আজ ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের স্মরণে শহিদি মার্চ পালন করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।  গতকাল বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সকলকে এই শহিদি মার্চ পালনের আহ্বান জানানো হয়েছে। 

সমন্বয়করা গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বৃহস্পতিবার সারা বাংলাদেশে আবারও শহিদ ও আহত ভাইদের স্মরণে এবং তাদের স্মৃতি ধারণ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এই কর্মসূচি পালিত হবে। সেখানে আহত এবং শহীদদের অভিভাবকদেরকেও অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান সমন্বয়করা। রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু হবে এই রোডমার্চ। নীলক্ষেত হয়ে কলাবাগান, এরপর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে ফার্মগেট হয়ে শহিদ মিনারে গিয়ে শেষ হবে এই কর্মসূচি। এতে যারা অংশ নেবেন তাদের উদ্দেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জানিয়েছে , মানুষ  যেমন বাংলাদেশ দেখতে চান, তা ব্যানারে লিখে নিয়ে আসবেন। এছাড়া কীভাবে সংবিধান বা দেশের উন্নয়ন করা যায় সেগুলোও ব্যানারে লিখে আনার পরামর্শ দেন তারা।


সর্বশেষ সংবাদ