ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একরুমে পাঁচ বিভাগের ক্লাস!
- মুহাইমিনুল ইসলাম, ঢাবি
- প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৪, ০৬:৪৪ PM , আপডেট: ২২ জুন ২০২৪, ০৮:০৮ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কলা ভবনে রুম সংকট চরমে উঠেছে। ফলে ভবনটির একটি রুমে ক্লাস করতে হচ্ছে ৫টি বিভাগের শিক্ষার্থীদের। তীব্র গরমে কলাভবনে গাদাগাদি করে ক্লাস করার ফলে হাঁসফাঁস অবস্থা শিক্ষার্থীদের। অনেকসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও ক্লাস করা যায় না। স্থান সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের ভাগ ভাগ করেও ক্লাস নেওয়া হয়। এতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রুম সংকট সমাধানে উদাসীন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, কলা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একাডেমিক ক্লাস হয় কলাভবনে। কলাভবনে ১৭ টি বিভাগে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ হাজার ৮৯৬ জন। প্রত্যেক শিক্ষাবর্ষে ২ হাজার ৯২৯ জন শিক্ষার্থী ক্লাস করে কলাভবনে। এ ভবনে থাকা ১৭টি বিভাগের মধ্যে ৮৫ শতাংশ বিভাগের মাত্র ২টি করে ক্লাসরুম।
কলা অনুষদে ৪০টির বেশি ক্লাসরুম আছে। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের চারটি ডিপার্টমেন্ট কলা অনুষদের রুম দখল করে আছে। কলাভবনের কোনো ক্লাসরুমই শূন্য থাকে না। আমি চাই না কলাভবনের কোনো ডিপার্টমেন্টের পারসোনাল কোনো রুম থাকুক। আমি চাই সবাই সবার রুমে উন্মুক্ত ক্লাস করবে—অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির, ডিন, কলা অনুষদ, ঢাবি।
কলা ভবনে মোট ৫৭টি রুমের মধ্যে ক্লাসরুম ৪০ টি। বাকি ১৭ টি রুম কলা অনুষদের ডিনের নিয়ন্ত্রণে। তিনি এ রুমগুলো সকল বিভাগের চাহিদা মোতাবেক যৌথভাবে ক্লাস নেওয়ার জন্য বরাদ্দ দিয়েছেন।
বর্তমানে কলাভবনে অনুষদটির ১৭টি বিভাগের মধ্যে উর্দু এবং পালি এণ্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগে মাত্র ১টি করে ক্লাসরুম রয়েছে। এছাড়া বাংলা বিভাগে রুম ২টি, আরবি বিভাগের ২টি, ফারসি বিভাগে ২টি, সংস্কৃত বিভাগে ২টি, ইতিহাস বিভাগে ২টি, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ২টি।
আরও পড়ুন: শিক্ষকদের আন্দোলন: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার শঙ্কা
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ২টি, তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার বিভাগে ২টি, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে ২টি, বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগে ২টি ,দর্শন বিভাগে ২টি, নৃত্যকলা বিভাগে ২টিসহ মোট স্থায়ী রুমের সংখ্যা ৪২টি। ইংরেজি বিভাগে ৪টি , সঙ্গীত বিভাগে ৫টি , থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে ৫টি ক্লাসরুম রয়েছে।
প্রত্যেক বিভাগে দুই বা ততোধিক রুম থাকলেও পালি এণ্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ ও উর্দু বিভাগে মাত্র ১টি করে রুম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। উর্দু বিভাগের প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্সের মোট পাঁচ বর্ষের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৪৪ জন এবং পালি এণ্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের পাঁচ ইয়ারের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩২৩ জন।
কলাভবনের ক্লাসরুম সংকটে ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুন শিক্ষার্থী ঠাসাঠাসি করে ক্লাস করে। এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চোখেই পড়ে না। একটি ডিপার্টমেন্টের পাঁচ ইয়ারের শিক্ষার্থীর জন্য একটা রুম কীভাবে বরাদ্দ দেওয়া এটা আমার বোধগম্য নয়—ঢাবি শিক্ষার্থী।
সরজমিনে দেখা যায়, পালি এণ্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগে একটি স্থায়ী রুম (৬০১৮) রয়েছে। এ বিভাগের মোট ৩২৩ শিক্ষার্থীর জন্য মাত্র একটি ক্লাস রুম। যেখানে প্রতি বর্ষে একসাথে ৬০-৬৫ জন শিক্ষার্থী গাদাগাদি করে ক্লাস করে। এ বিভাগের তীব্র ক্লাসরুম সংকটের কারণে ক্লাস করতে ভোগান্তি পোহাতে হয় অনার্স ১ম বর্ষ থেকে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের। অনেকসময় তীব্র রুম সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে যৌথ রুম (অন্য বিভাগের সাথে রুম শেয়ার করা) ৬ হাজার ৬০ এবং ৬ হাজার ৭১ নং রুমে ক্লাস করতে হয়। রুম সংকটের কারণে ক্লাস শিডিউল ও এলোমেলো হয়। সকালে দুপুরে এবং বিকালে রীতিমতো বাধ্য হয়ে ক্লাস করতে হয় এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের।
এক রুমে ৫ বিভাগের ক্লাস
কলাভবনে ক্লাস করা শিক্ষার্থীদের কাছে এক ভোগান্তির ক্লাসরুম ৬০৭১। এই রুমে নেই কোনো এসি, ঠিকমতো ফ্যান ও ঘুরে না ,মাইক্রোফোনেও মাঝেমধ্যে শোনা যায় না শিক্ষকের কথা। তারপরও এই রুমে ক্লাস হয় ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ইংরেজি, ইসলামিক স্টাডিজ, পালি এণ্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগসহ ৫ বিভাগের শিক্ষার্থীদের।
নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত এই কলাভবনে নেই কোনো সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা। প্রতিটি বিভাগের ওয়াশরুমে যেন নাজেহাল অবস্থা, নিয়মিত পরিষ্কারের অভাবে দুর্গন্ধময় ওয়াশরুম ব্যবহার করতে পারেন না অনেক শিক্ষার্থী। এছাড়া ক্লাসরুম এগুলোতে ঠিকমতো বিদ্যুৎ থাকে না, বিদ্যুৎ থাকলেও অনেকসময় ক্লাসরুমে বা পরীক্ষা চলাকালীন ৫ তলার পরীক্ষাকেন্দ্রে এসি বন্ধ করে রাখা হয় বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
বর্তমানে কলা ভবনে অনুষদটির ১৭টি বিভাগের মধ্যে উর্দু এবং পালি এণ্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগে মাত্র ১টি করে ক্লাসরুম রয়েছে। এছাড়া বাংলা বিভাগে রুম ২টি, আরবি বিভাগের ২টি, ফারসি বিভাগে ২টি, সংস্কৃত বিভাগে ২টি, ইতিহাস বিভাগে ২টি, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ২টি।
অথচ আকাশচুম্বী বিদ্যুৎ বিলের পাহাড় এই কলাভবনে। প্রতিমাসে বিদ্যুৎ বিল আসে প্রায় ১০লাখের বেশি টাকা। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে কলাভবনের বিদ্যুতের মিটার বিল আসে ১৮ লাখ ৩৬ হাজার ৯শত ৭৫ টাকা। তার পূর্বের মাস জুনে বিদ্যুৎ বিল ছিল ১৩ লাখ ৪৯ হাজার ৪শত ৭৪ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে কলাভবনের বিদ্যুৎ বিল বেড়ে দাড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৫০১ টাকা। বিদ্যুৎ বিলের এই অসমতাকে হাস্যকর বলে মনে করছেন কলা অনুষদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রোকেয়া হলের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কলাভবনের ক্লাসরুম সংকট, এটি যেন ভয়ানক ব্যাধি। ক্লাসরুমের ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণ শিক্ষার্থী ঠাসাঠাসি করে ক্লাস করে। অথচ এটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চোখেই পড়ে না। একটি ডিপার্টমেন্টের পাঁচ ইয়ারের শিক্ষার্থীর জন্য একটা রুম কীভাবে বরাদ্দ দেওয়া এটা আমার বোধগম্য নয়। ঠিকমতো লাইট, ফ্যান ও এসি চলে না। ডিন মহোদয়ের উচিত প্রত্যেক বিভাগের জন্য সমভাবে রুম নিশ্চিত করা।
চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ফারজানা বলেন, একজন শিক্ষার্থীর জন্য সকালে একটি ক্লাস, দুপুরে একটি ক্লাস, বিকালে একটি ক্লাস করা রীতিমতো অত্যাচার করার সমান। অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা বেবি বাসায় রেখে ক্লাসে আছে, তাদের ক্ষেত্রে সকাল বিকাল ক্লাস করা খুবই কষ্টসাধ্য।
আরও পড়ুন: ৫৪ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পকেটে বার্ষিক উদ্বৃত্ত ১২৫০ কোটি টাকা
ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী সাজিদ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের ক্লাসে ১০০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ধারণক্ষমতা রয়েছে ৭০ জনের। বাকি শিক্ষার্থীরা আলাদা চেয়ার এনে, কখনও শিক্ষকদের ডেস্কের পাশে বসে বসে ক্লাস করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে এখনো নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কলা অনুষদে ৪০টির বেশি ক্লাসরুম আছে। কোনো ডিপার্টমেন্ট যদি রুমের বরাদ্দ চায়, তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। কিছু ডিপার্টমেন্ট ডিন অফিসের নামে ভুল তথ্য প্রচার করে। ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, পপুলেশন সায়েন্স, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, ফিল্ম এন্ড ফটোগ্রাফি স্টাডিজসহ সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের চারটা ডিপার্টমেন্ট কলা অনুষদের রুম দখল করে আছে। কলাভবনের কোনো ক্লাসরুমই শূন্য থাকে না।
‘আমি চাই না কলাভবনের কোনো ডিপার্টমেন্টের পারসোনাল রুম থাকুক। আমি চাই সবাই সবার রুমে উন্মুক্ত ক্লাস করবে। কিছু ডিপার্টমেন্ট পারসোনাল রুম বরাদ্দের জন্য এসেছিল, কিন্তু আমি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছি। এটা আমার পলিসি।’
পালি এণ্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের ক্লাস রুম সংকট নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পালি এণ্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ ডিজিটাল ডিভাইসের অন্তর্ভুক্ত থাকায়, তারা চাইলেই অন্যরুমগুলোতে ক্লাস করতে পারে না। সকাল ৮ টায় রুম ফাঁকা থাকে, তারা চাইলে সকাল ৮ টায় ক্লাস করতে পারবে। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান এসেছিল রুমের বিষয়ে কথা বলতে। আমি আবেদনপত্র জমা দিতে বলেছি। আবেদনপত্র পেলে আমরা চাহিদা অনুযায়ী সর্বোচ্চ আসন দিতে পারবো।