রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১৩ কোটি টাকার অডিট আপত্তি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়  © লোগো

২০২১-২২ অর্থবছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও গড়মিল পেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। দেশের সর্বোচ্চ অডিট প্রতিষ্ঠান মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) থেকে প্রকাশিত এক অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও ২৫টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ অডিট পরিচালনা করা হয়। অডিটে বরাদ্দের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যয়, ব্যাংক থেকে অর্জিত সুদ সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া, ভর্তি পরীক্ষার আয়-ব্যয়ের হিসাব গোপন করা, বই ক্রয়ে অনিয়মিত ব্যয়, ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে বিধি বহির্ভূত ব্যয়, ঋণ পরিশোধের নামে অতিরিক্ত ব্যয়, বিধি বহির্ভূত মেডিকেল যন্ত্রাংশ ক্রয়সহ মোট ২২টি খাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়েছে। এদের মধ্যে ৮ টি খাতে মোট ১১২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার ব্যয়ের বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে এককভাবে এবং অবশিষ্ট ১৪ টি বিষয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বিতভাবে আপত্তি জানানো হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ ছিল ১৩৩ কোটি ৩৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা। কিন্তু ব্যয় করেছে ১৬৪ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। ফলে বিভিন্ন খাতে বাজেট বরাদ্দের অতিরিক্ত ৩১ কোটি ১৭ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ব্যয় করেছে প্রশাসন। যা সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। 

একই অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প'র আওতায় সোনালী ব্যাংক, রাবি শাখা থেকে ২১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৫ টাকা সুদ পায় রাবি প্রশাসন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী উক্ত অর্জিত সুদ সরকারি কোষাগারে জমা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উক্ত টাকা সরকারি কোষাগারে প্রদান করেনি। ফলে ২১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৫ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। 

২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) ভর্তি পরীক্ষার নিরীক্ষাযোগ্য রেকর্ডপত্র ও আয়-ব্যয়ের প্রাপ্ত টাকার হিসাবও উপস্থাপন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সিএজি নিরীক্ষা বলছে, এ অর্থবছরে প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) ভর্তি পরীক্ষা থেকে ১৭ কোটি ৮২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা আয় করে রাবি। কিন্তু উক্ত আয় এবং ব্যয়ের অডিট উপস্থাপন করেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সিএজি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এই হিসাবের আয়-ব্যয় এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র অডিট উপস্থাপনের জন্য চাহিদা প্রদান করা হলেও রাবি কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো জবাব বা সহযোগিতা প্রদান করেনি।  

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে কোনোরূপ ক্রয়মূল্য ছাড়ায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে বিভাজন করে বই ক্রয় বাবদ অনিয়মিতভাবে ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৪৮৩ টাকা ব্যয় করে বিশ্ববিদ্যালয়। অডিট দলের মতে বছরের শেষ দিন (৩০ জুন) ব্যয় দেখানোর উদ্দেশ্যেই এই ক্রয় সম্পাদন করেন তাঁরা। যা সাধারণ আর্থিক বিধিমালা (জিএফআর) ১০৩ মোতাবেক আর্থিক নিয়ম ভঙ্গ করার সামিল। 

একই অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন' (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পে কার্যাদেশের শর্ত মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পাদনে ঠিকাদার ব্যর্থ হওয়ায় 'পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা-২০০৮' (পিপিআর) মোতাবেক চুক্তি বাতিল ও ঠিকাদারের পারফরম্যান্স সিকিউরিটি বাজেয়াপ্ত না করায় ৬৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে।  

সিএজি কর্তৃপক্ষ আরো বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন' (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পে ২০২১-২২ অর্থবছরে কার্যাদেশের শর্ত মোতাবেক নির্ধারিত সময়ে সময় বৃদ্ধির আবেদন করতে ঠিকাদার ব্যর্থ হওয়ায় পিপিআর ২০০৮ মোতাবেক চুক্তি বাতিল না করে ঠিকাদারকে অনিয়মিতভাবে ৬ কোটি ৫১ লাখ ৬৬ হাজার ১০০ টাকা পরিশোধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। 

এ অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটে ঋণ গ্রহণ বাবদ প্রাপ্তি না দেখানো হলেও ঋণ পরিশোধের নামে বাজেটে ৫৫ কোটি ২৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে। ঋণ পরিশোধের নামে অর্থ ব্যয়ের সপক্ষে কোনো বিল ভাউচার বা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কর্তৃপক্ষ প্রদান করতে পারেননি। সিএজি মনে করছে, প্রকৃত ব্যয় অপেক্ষা অধিক ব্যয় দেখিয়ে ঋণ পরিশোধের নামে ৫৫ কোটি ২৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা অন্যত্র স্থানান্তর বা অননুমোদিত কোনো খাতে ব্যয় করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনসহ মেডিকেল যন্ত্রাংশ ক্রয় করার ক্ষেত্রেও পিপিআর ২০০৮ লঙ্ঘন করে ১ কোটি ৫ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অনিয়মিতভাবে ব্যয় হয়েছে।

এছাড়াও, কিছু বিষয়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সমন্বিতভাবে অডিট আপত্তি এসেছে। এগুলো হলো- বিধি বহির্ভূতভাবে শিক্ষকগণকে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ৫ কোটি ৪১ লাখ ৮১ হাজার ৯৭ টাকা, শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণকে প্রদত্ত অগ্রিম সমন্বয় করা হয়নি ১৮ কোটি ৯০ হাজার ৮ টাকা, বিডি রেন (BIREN) কর্তৃক প্রদত্ত ইন্টারনেট সেবার বিপরীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে বরাদ্দকৃত সরকারের অনুদান মঞ্জুরী হতে ইউজিসি কর্তৃক অনিয়মিতভাবে কর্তন ১ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা, সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করায় আর্থিক ক্ষতি ১৬২ কোটি ৪৯ লাখ ৪৫ হাজার ৪০৩ টাকা, ইউজিসি'র নির্দেশনা অমান্য করে আবাসিক কোয়ার্টারে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে ভর্তুকি প্রদান করায় ১ কোটি ৬৬ লাখ ৭ হাজার ২৮৮ টাকার আর্থিক ক্ষতি।

শিক্ষকগণকে বিধি বহির্ভূতভাবে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত বই ভাতা প্রদান করায় আর্থিক ক্ষতি ২ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার ৭৬৯ টাকা, দোকান ও মার্কেট ভাড়া বাবদ অনাদায়ী অর্থ আদায় না করায় আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ৮৫ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮১ টাকা, নির্ধারিত চাকুরিকাল শেষ হওয়ার পরেও সেশন বেনিফিটের নামে শিক্ষকদের বিধি বহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত সময়ের চাকরির সুযোগ প্রদান করে বেতন ভাতাদি পরিশোধ করায় আর্থিক ক্ষতি ৪ কোটি ২৮ লাখ ৮৯ হাজার ৫৭০ টাকা, উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই ক্রয়মূল্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাজনপূর্বক কোটেশন, সীমিত দরপত্র ও নগদে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, গবেষণাগার সরঞ্জাম ও শিক্ষণ উপকরণ ক্রয়ের বাবদ অনিয়মিতভাবে ব্যয় ১৩ কোটি ২১ লাখ ১২ হাজার ১৯০ টাকা।  

বিধি বহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পদে দৈনিক মজুরী হারে পদবীভিত্তিক কর্মচারী নিয়োগ প্রদানে আর্থিক ক্ষতি ১৯ লাখ ৭০ হাজার ২০০ টাকা, ইউজিসি'র নির্দেশনা অমান্য করে বিভিন্ন পদে এডহকভিত্তিক/বিধি বহির্ভূতভাবে চুক্তিভিত্তিক জনবল নিয়োগে বেতন ভাতা পরিশোধ করায় আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ১২ লাখ ২৫ হাজার ৯১০ টাকা, উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই ক্রয়মূল্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাজনপূর্বক কোটেশন, সীমিত দরপত্র ও নগদ ক্রয়ের মাধ্যমে, ভবন ও স্থাপনা মেরামত কাজে অনিয়মিতভাবে ব্যয় ১৯ কোটি ৫৪ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭২ টাকা, প্রদত্ত সম্মানী বিল থেকে কর্তনকৃত আয়কর পরিশোধকারী কর্তৃক সরকারি কোষাগারে জমা না করায় ৫ কোটি ১১ লাখ ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ/অনুষদ/কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত নথি/সান্ধ্যকালীন কোর্সের আয়-ব্যয়ের হিসাব ও নিরীক্ষাযোগ্য রেকর্ডপত্র অডিটে উপস্থাপন করেনি কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিট সেলের উপ-পরিচালক মো. মাসুম আল রশিদ বলেন, সিএজি কর্তৃপক্ষ যে বিষয়গুলোর উপর আপত্তি জানিয়েছে সেগুলোর যৌক্তিক জবাব আমাদের কাছে আছে। আমরা খুব দ্রুতই তাদের কাছে জবাব পাঠাবো। তবে দু'একটি বিষয়ে আমাদের যে ত্রুটি বিচ্যুতি হচ্ছে না যে তা নয়। তবে ভর্তি পরীক্ষার আয়-ব্যয়ের হিসাব না দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অডিট আপত্তির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ শামসুল আরেফিন বলেন, অডিট আপত্তি একটি স্বাভাবিক বিষয়। প্রতিবছরই সিএজি কর্তৃপক্ষ আপত্তি জানায়। তারপর আমরা জবাব দিয়ে বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করি। এটা এমন নয় যে এবারই প্রথম। এরকম প্রতি বছরেই হয়ে থাকে। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় না; বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ মন্ত্রণালয়েও অডিট আপত্তি হয়ে থাকে। আপত্তি উঠেছে বলেই যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে এমনটা বলা যাবে না।


সর্বশেষ সংবাদ