সিন্ডিকেট ও অনিয়মিত কমিটিই ডুবিয়েছে ছাত্রদলকে
- এম টি রহমান
- প্রকাশ: ২৩ জুন ২০১৯, ১২:১৪ PM , আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯, ০২:৫০ PM
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি করতে বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার পর থেকেই নতুন জটিলতা শুরু হয়েছে সংগঠনটিতে। যারা দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রদলের রাজনীতি করে আসছেন তারা বঞ্চিত হচ্ছেন, এমন ক্ষোভ থেকে ধারাবাহিক আন্দোলন শুরু করেছেন। তাদের দাবি, অন্তত ছয় মাসের জন্য হলেও একটি কমিটি ঘোষণা করা হোক। এ আন্দোলনের কারণে নয়া পল্টনে বিএনপির পার্টি অফিসে তালা দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে কিছু অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে।
এরইমধ্যে শনিবার রাতে এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছাত্রদলের সাবেক ও বর্তমান ১২জন নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষরকৃত বিজ্ঞপ্তিতে তাদেরকে দলের সব ধরণের কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এর কারণ হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা বহির্ভূত কর্মকান্ডে জড়িত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগ তোলা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকেই।
ছাত্রদলের নেতারা জানিয়েছেন, ২০০৮ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপির পাশাপাশি ছাত্রদলও কোনঠাসা অবস্থায় রয়েছে। এতে ছাত্রদল বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। কারণ দলটিতে নতুন সক্রিয় কর্মী কমেছে ধারাবাহিকভাবে। এ অবস্থায় ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১০ কিংবা তারও এক কিংবা দুবছর পর যারা ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন, তারাই ছাত্রদলের হাল ধরে রেখেছেন।
শনিবারের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে তারাও ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মহানগর এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে তাদেরকে বহিষ্কার করা নিয়ে ছাত্রদলের অনেকেই এখন প্রশ্ন তুলছেন। তাদের মতে, ছাত্রদলের কমিটি নিয়মিত না হাওয়ায় তারা দীর্ঘদিন ধরেই বঞ্চিত। এখন ২০০০ সাল ধরে যে বয়সসীমা নির্ধারণ করা হচ্ছে, তাতে তারা পুরোপুরি বঞ্চিতই থেকে যাবেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের দফতর সম্পাদক এস এম ইসামন্তাজ ইজাজ শাহ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বিএনপির হাইকমান্ড বহিষ্কারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা একেবারেই অযৌক্তিক। এরমাধ্যমে হয়ত আমরা যারা ২০০০ সালের পরের ব্যাচ তারা লাভবান হতে পারি কিন্তু সার্বিকভাবে ছাত্রদল বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। এতদিন যারা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে রাজনীতি করে আসছে তাদেরকে এভাবে বাদ দিয়ে দেওয়া যৌক্তিক হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘ঘরে যেমন ছেলেদের সমস্যা হলে বাবা-মা সমাধান করে দেন, বিএনপিরও সেভাবে বিষয়টি সমাধান করা উচিৎ। এছাড়া বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কখনো ছাত্রদলকে নিয়ে সামগ্রিকভাবে বসেননি, কথা বলেননি। ফলে সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে।’
জানা গেছে, যারা গত কয়েকদিন ধরে আন্দোলনে ছিলেন তারাসহ ছাত্রদলের একটি বড় অংশেরই দাবিগুলোতে সমর্থন রয়েছে। এভাবে বহিষ্কার করে ছাত্রদলের সমস্যার সমাধান হবে না বলে অভিমত তাদের। এছাড়া এতদিন আন্দোলনে অংশ না নিলেও অনেকে এখন সক্রিয় হয়ে বিএনপির সিদ্ধান্তের প্রকাশ্যে সমালোচনা শুরু করেছেন। প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় বহিষ্কার হতে তারা মাঠে নামবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন।
ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি আনোয়ারুল হক রয়েল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যদি উদ্দেশ্য সৎ হয়- তবে বাধাগ্রস্ত হলে ভয় নেই, গতি আরো বাড়িয়ে দাও।’ আর সাবেক সহ সাংগঠনিক সম্পাদক রয়েল সরদার লিখেছেন, ‘দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ আসার পরও যেহেতু আওয়ামী সরকার এক মুহুর্তের জন্য মাঠ ছাড়া করতে পারেনি, সুতরাং কয়েকজনকে বহিষ্কার করে আন্দোলন থেকে আমাদের সরিয়ে ফেলবেন এটা ভাবলেন কি করে? সোমবার থেকে আমরা প্রত্যেকে বহিষ্কার হওয়ার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে আসব। হয় সিন্ডিকেট থাকবে ,নতুবা ইতিহাস রচিত হবে।’
আন্দোলনে যুক্ত নেতারা জানিয়েছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র হওয়ার পাশাপাশি ২০০০ সাল থেকে পরবর্তীতে যেকোন বছরে এসএসসি/সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে বলে নিয়ম করা হয়েছে। এভাবে কেন্দ্রীয় কমিটি করা হলে অধিকাংশ নেতার বয়স হবে ৩৫ বছরের কাছাকাছি। কিন্তু যারা এখন অন্তত ছয় মাসের জন্য হলেও একটি কেন্দ্রীয় কমিটি চাচ্ছেন তাদের বয়স এর থেকে তিন/চার বছর বেশি হবে। কমিটি স্থান পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা কি অপরাধ করেছেন? এমন প্রশ্নও তাদের। এজন্য সিন্ডিকেটের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে তারা মনে করেন।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে ছাত্রদল যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তারচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সিন্ডিকেটের কারণে। যখনই ছাত্রদলকে গতিশীল ও নিয়মিত কমিটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তখনই সিন্ডিকেটগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই তারা বাঁধা দিয়েছে কমিটিতে। ফলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটি দুই বছর মেয়াদী হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচ বছরও পার করার নজির তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ রাজিব-আকরাম কমিটিও চার বছরের অধিক সময় পার করে চুড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলে ছাত্রদলে সক্রিয় অনেক নেতার অভিযোগ।
ছাত্রদলের সদ্য বিদায়ী কমিটির সহ সভাপতি ছিলেন এজমল হোসেন পাইলট। তিনি চলমান আন্দোলনেও পরিচিত মুখ। শনিবারের সিদ্ধান্তে বহিষ্কার হওয়ার পর কি করবেন জানতে চাইলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আপাতত কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। সন্ধ্যায় আমরা বহিষ্কার হওয়া ১২জন আলোচনা করব। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।’ তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপি-ছাত্রদলের সঙ্গেই আছি। আগামীতেও থাকতে চাই।’
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে ছাত্রদলের নেতৃত্বে আসেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানী-হাবীব-উন-নবী সোহেল কমিটি। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সভাপতির পদে ছিলেন এ্যানী। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হাবীব-উন-নবী সোহেল। পরে সোহেল ২০০০ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। এ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নাসিরুদ্দিন আহমেদ পিন্টু। এরপর ২০০২ সাল পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
২০০২ সালের শেষের দিকে মাত্র চার মাসের জন্য ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন এবিএম মোশারফ হোসেন। ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শফিউল বারী বাবু। আর ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতির পদ ছিলেন সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। টুকুর কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আমিরুল ইসলাম খান আলীম।
সার্বিকভাবে ১৯৯৬ সালে গঠিত হয় এ্যানি-সোহেল কমিটি। এরপর সোহেল-পিন্টু (১৯৯৮-২০০০), পিন্টু-লাল্টু (২০০০-২০০২), লাল্টু-মোশারফ (২০০২-২০০৩) , লাল্টু-হেলাল (২০০৩-২০০৪), হেলাল-বাবু (২০০৫-২০০৯), টুকু-আলীম (২০০৯-২০১২) এবং ২০১২ সালে জুয়েল-হাবীব কমিটি। ১৬ বছরে কমিটি হয়েছে আটটি। তবে একজনই একাধিকা কমিটির শীর্ষ নেতা হওয়ায় নতুন নেতা পায়নি ছাত্রদল।
২০১২ সালে আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে সভাপতি করে ও হাবিবুর রশীদ হাবিবের সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ২০১৩ সালে এ কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর রাজীব আহসানকে সভাপতি ও মো. আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন দেন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। আংশিক ওই কমিটি ছিল ১৫৩ সদস্যের। যা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংখ্যার চেয়ে দুজন বেশি।
এর ১৫ মাস ২০১৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করা হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটি ১৫১ সদস্যের হলেও এতে জায়গা পান ৭৩৬ জন! সে সময় এমন কথাও ওঠে, ‘ছাত্রদলে কোনো কর্মী নেই, সবাই নেতা।’ রাজিব-আকরাম কমিটি প্রায় পাঁচ বছর পার করার পর গত ৩ জুন তা বাতিল করে বিএনপি। পরে ২০০০ সাল থেকে পরবর্তীতে যেকোন বছরে এসএসসি/সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে বলে যে নিয়ম করা হয়েছে তা নিয়েই ছাত্রদলে জটিলতা চরম আকার ধারণ করেছে।
ছাত্রদল নেতাদের অভিযোগ, বিএনপির সুবিধাভোগী এবং সিন্ডিকেট মিলে হঠাৎ বয়স নামিয়ে পছন্দের লোক দিয়ে কমিটি করতে চায়। আকস্মিক এই সিদ্ধান্ত তারা মানেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন। সংকটের জন্য বিএনপির হাইকমাণ্ড বা সিন্ডিকেট দায়ী। এর সমাধান দলকেই করতে হবে বলেও তারা জানিয়েছেন।
আন্দোলনরত ছাত্রদল নেতাদের অভিযোগ, প্রায় ১৩ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। এসময় হামলা-মামলায় জর্জরিত ছাত্রদল নেতাদেরকে কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড প্রায় ক্ষেত্রেই তাদের কোনো খোঁজ নেননি। জেলে থাকলেও তাদেরকে তারা সহযোগিতা পাননি। এছাড়া বিএনপির অনেক নেতা ছাত্রদলের ব্যাপারে কোন খবর রাখেন না বলেও অভিযোগ তাদের। অথচ ছাত্রদলই বিএনপির রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় শক্তি বলে মনে করেন তারা।
ছাত্রদল নেতারা বলেন, নিয়মিত কমিটি না হওয়া এবং সিন্ডিকেটের কারণে আজ চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে ছাত্রদল। এখন ছাত্রদলকে রক্ষা করতে বিএনপিকে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় বাইরে থাকায় কঠিন সময় পার করছেন তারা। এ অবস্থায় সমস্যার সমাধান না করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসবে না।