সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ দিচ্ছে আ’লীগ, প্রস্তুত ছাত্রলীগ
- ফয়সাল খান
- প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০১৯, ১২:১৪ PM , আপডেট: ৩০ মার্চ ২০১৯, ১২:২৯ PM
দীর্ঘ ২৮ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) কার্যকর হওয়ার জন্য নিজেদের সফল হিসেবে দেখছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এজন্য ডাকসুর মতো দেশের সকল স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি কলেজগুলোতে নির্বাচন দেয়ার পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগ। বর্তমান অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বায়ত্বশাসিত হওয়ায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ইতিমধ্যে প্রভোস্ট কমিটির এক সভায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আলোচনা চলছে। তাই দেশব্যাপী সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে নিজেদের ছাত্র সংগঠনগুলোকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন দলের শীর্ষ নেতারা।
জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরের পর বছর বন্ধ হয়ে আছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। তবে গত ১১ মার্চ দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। এর আগে ১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। একইভাবে ১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), ১৯৯০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) ও ১৯৯২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (জাকসু) সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও তা ভেস্তে যায়। তবে এবার এসব প্রতিষ্ঠানে সকল ছাত্রসংগঠনের অংশগ্রহণে বিতর্কমুক্ত গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে ছাত্রনেতৃত্ব তৈরি করার পাশাপাশি দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সম্পর্কে আগাম ধারণা নিতে চায় আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে সারা দেশে ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক অবস্থানের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নিতে চায় দলটি।
সূত্রমতে, দলের এমন চিন্তার কথা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদেরও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ডাকসু নির্বাচনের পরদিন গত ১২ মার্চ আওয়ামী লীগ সভাপতির ঢাকার ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে নির্দেশনা দেন দলের সিনিয়র নেতারা। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, দুই সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে বৈঠক করেন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন নেতা। বৈঠকে সারাদেশে ছাত্র নেতাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে না জড়াতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়। পাশাপাশি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে যেতে এবং তাদের সমর্থন নিয়েই জয়লাভ করতে হবে বলে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ বা অন্য কোনো ছাত্রসংগঠন যদি কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চায় তবে তা কঠোরভাবে দমন করার হুশিয়ারিও দেয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি মেহেদী হাসান বলেন, আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি না পেলেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলেতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে মৌখিক নির্দেশনা পেয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনের পর ঢাকার বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতারাও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। কেন্দ্রের নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনের ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে প্যানেল তৈরির কাজ শুরু করা হবে বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডাকসু নির্বাচনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠানের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘চাকসু নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে। গত ২০ মার্চ প্রভোস্ট কমিটির সভা ছিল। ওই সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নীতিমালা সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী চাকসুর নীতিমালা নতুন করে প্রণয়ন করা হবে। এ ছাড়া সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা হবে। সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হলেই চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।'
সূত্র জানায়, সব আবাসিক হলের প্রভোস্টকে চাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হবে। প্রায় ২৯ বছর ধরে চাকসু নির্বাচন না হওয়ায়, প্রথমে একটি কমিটি গঠন করে নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনা হবে। আর এই নীতিমালা পর্যালোচনা করার জন্য উপাচার্য আরেকটি কমিটি গঠন করবেন। পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনিক কমিটি রাষ্ট্রীয় অনুমোদন নিয়ে নির্বাচন দেয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।
রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদের নির্বাচনের আওয়াজ উঠেছে। দ্রম্নত নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানাচ্ছে ছাত্রসংগঠনগুলো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগও নিয়েছে বলে জানা গেছে। তাছাড়া ঢাকার মধ্যে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ছাত্র সংসদের বিধান না থাকলেও এরই মধ্যে ডাকসুর আদলে গঠনতন্ত্র তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, 'অনেক বছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে কোনো সংসদ ছিল না। নির্বাচনের প্রক্রিয়াও অনেক বিস্তৃত। ডাকসু নির্বাচনের আদলেই ছাত্র সংসদ নীতিমালা করব। একই আদলে গঠনতন্ত্র তৈরি করে একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে পাস করে তা অনুমোদনের জন্য জাতীয় সংসদে পাঠাব।'
গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (বাকসু) নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য ড. মোহাম্মদ আলী আকবর জানান, বাকসু নির্বাচনের বিষয়ে ভাবছেন তারা। প্রশাসন কখনোই বাকসু নির্বাচনের বিরোধী নয়। শিক্ষার্থীরা চাইলে অবশ্যই নির্বাচনের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হবে। বাকসু নির্বাচন হলে ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন ইস্যু সহজেই সমাধান করা সম্ভব হবে।'
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর নিয়মিতই কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। সর্বশেষ ১৯৯৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় বাকসু নির্বাচন। কিন্তু গত দুই দশকে নির্বাচন না হওয়ার পরও ছাত্র সংসদ খাত দেখিয়ে প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি নেয়া হচ্ছে। নির্বাচন না হওয়ায় একদিকে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটছে না, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের পথও নিশ্চিত হচ্ছে না। নির্বাচন বন্ধ থাকায় গণতন্ত্রের যে চর্চা হওয়া দরকার, সেটি হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া আদায়ের কোনো প্ল্যাটফর্মও নেই। তাছাড়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সরকারি কলেজসমূহ ছাত্রসংসদ নির্বাচন আদায় করতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ছাত্র সংগঠনগুলো।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তাদের অধীনে ২ হাজার ২৬০টি কলেজ রয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো সরকারি এবং বেসরকারি বড় কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা। একসঙ্গে না করে ভাগ ভাগ করে এই নির্বাচন করতে চাচ্ছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেন, শিগগিরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভায় এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে গাজীপুর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল আলম রবিন বলেন, জেলার অনার্স পর্যায়ের বিভিন্ন কলেজে ছাত্র সংসদ সচল করার দবি উঠেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সেই দাবির সঙ্গে ছাত্রলীগও একমত। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠনগুলোতে কার্যকর ছাত্র সংসদ থাকলে পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মঝে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত হবে বলে মনে করেন তিনি।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ সচল থাকাকালে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে মুখর ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রায় প্রতিদিনই হল সংসদে কোনো-না-কোনো অনুষ্ঠান থাকত। ছাত্রসংসদ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড আগের মতো নেই। বেসরকারি কিছু বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি চর্চা থেকে একেবারেই দূরে সরে আছে। সুস্থ সাংস্কৃতিক না থাকায় সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক, ইভটিজিং এমনকি ধর্ষণের মতো অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে ছাত্ররা। ছাত্রসংসদ সচল থাকলে এ ধরনের অপকর্ম থেকে ছাত্রসমাজ সাহিত্য ও সাংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোর খোঁজখবর নিচ্ছে সরকার। এরপর নির্বাচন উপযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেয়া হবে।
তবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসন। সেখানে আওয়ামী লীগের ও সরকারের হস্তক্ষেপ করার কিছু নেই। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে সেসব নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে নানা দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দিতে পারে। দলের দায়িত্বশীল নেতারা আলোচনা করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করে প্রার্থী মনোনীত করতে পারেন। এর বাইরে দলের কারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি বলেন, 'দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হলো। পর্যায়ক্রমে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হবে। যেখানে প্রতিবছর স্কুলের নির্বাচন করছি, সেখানে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হওয়াটাও জরুরি। সব শিক্ষপ্রতিষ্ঠানের নিজেদের প্রস্তুতি ও সিদ্ধান্তের বিষয় রয়েছে। যেহেতু এটি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সেটি কারও ওপর চাপিয়ে দিতে চাই না। আমরা চাই সুন্দর পরিবেশে, সুষ্ঠুভাবে সব প্রতিষ্ঠানে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চর্চা হোক। সব জয়াগায় ছাত্রসংসদ নির্বাচন করা উচিত। এ ব্যাপারে আমাদের দিক থেকে সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।'