ই-কমার্সে ঝুঁকছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট উদ্যোক্তারা
- ইরফান এইচ সায়েম
- প্রকাশ: ২৮ এপ্রিল ২০২১, ১০:৩৫ AM , আপডেট: ১৩ মে ২০২১, ০৩:০৮ PM
ছোটবেলা থেকেই নিজে কিছু একটা করে স্বাবলম্বী হওয়ার অদম্য ইচ্ছে ছিল। কিন্ত স্কুল-কলেজের পড়াকালীন সময়ে সেটি করা আর সুযোগ হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার ভালোভাবে এর গুরুত্ব অনুভব করি যে, নিজের একটা পরিচয় খুব দরকার। আর এই নিজের পরিচয় তৈরি করার জন্যই দুইজন মিলে হ্যান্ড পেইন্টেড ব্যাগ নিয়ে আমাদের উদ্যোগ শুরু করি। এরপর থেকে ই-কমার্সের যাত্রা শুরু। কথাগুলো বলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের ছাত্রী মেহেরুন নেছা তন্নি।
তিনি তার এক কাজিনকে নিয়ে মায়াচিত্র নামে ফেসবুক পেজ থেকে শুরু করেন এই ই-কমার্স বা এফ কমার্স প্লাটফর্ম। এখান থেকে হ্যান্ড পেইন্টেড ব্যাগ ছাড়াও বর্তমানে চিঠি লেখার কাগজ ও কাস্টমাইজড প্যাড ও নোটবুক, বিভিন্ন ধরণের ড্রেস (শাড়ি, থ্রিপিস, ওয়েস্টার্ন, প্যান্ট ইত্যাদি) ও ছেলেদের পাঞ্জাবি, শার্ট, টিশার্ট বিক্রি হচ্ছে। ঘরে বসেই যেকেউ কিনতে পারবেন এসব পণ্য।
শুধু তন্নি নয়, গত বছর করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের অনেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে পথচলা করেছেন। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে ঘরে বসেই অনলাইনে পণ্য বেচাকেনা করছেন তারা। এতে তাঁরা যেমন পণ্যের যথাযথ দাম পাচ্ছেন, তেমনি তাঁদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমে গেছে। অন্যদিকে, এসব তরুণ সমাজকে স্বাবলম্বী হওয়ার সহজ ও সুন্দর পথ দেখিয়েছে ই-কমার্স, তথা ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা।
বর্তমানে কত সংখ্যক শিক্ষার্থী এখানে আসছেন তার কোন নির্দিষ্ট তথ্য নেই সরকারি বা বেসরকারিভাবে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটি (ডিবিসি) নামের একটি ফেসবুক গ্রুপের তথ্য মতে, বর্তমানে সারাদেশে ঢাবি পড়ুয়া সাড়ে ৪০০ শিক্ষার্থী উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে জড়িত রয়েছে। তাদের একটি বড় অংশ আলাদীনের প্রদীপ নামে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনা করেন। তাছাড়াও দেশের শীর্ষ ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম দারাজ, ই-ভ্যালিসহ অনেক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনা করে থাকেন অনেকেই।
ঢাবিয়ান বিজনেস কমিউনিটির (ডিবিসি) এডমিন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম কালিভার্ডের অন্যতম উদ্যোক্তা ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, চলতি বছরের শুরু দিকে ডিবিসির একটি জরিপে ৩৪৭ জন উদ্যোক্তার নাম ও তাদের প্ল্যাটফর্মের তালিকা আমাদের সংগ্রহে রয়েছে। বর্তমানে সেটি সাড়ে ৪০০ হবে। উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া। তবে কিছু সাবেক শিক্ষার্থীও রয়েছে এরমধ্যে।
ডিবিসি ফেসবুক গ্রুপটিতে বর্তমানে সদস্য সংখ্যা ২৪ হাজারেরও বেশি। সেখানে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি অনেক সাধারণ শিক্ষার্থীও রয়েছেন। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পণ্য বেচাকেনা করে থাকেন অনেকেই। ইমতিয়াজের মতে, এ মুহুর্তে ঢাবির কতজন উদ্যোক্তা হিসেবে ই-কমার্সের সঙ্গে জড়িত সেটা বলা মুশকিল। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে গত বছরের করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে এটি অনেক বেড়েছে।
করোনার প্রাদুর্ভাবে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় ঢাবির কবি জসিমউদ্দিন হলের শিক্ষার্থী আরিফ হোসেন বাড়িতে অবস্থান করছেন। ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়ে টিউশনি করে হাত খরচ জোগাড় করতে পারতেন। বাড়িতে অবস্থান করায় টিউশনি বন্ধ। তবে দেশের বাড়ি কুুমিল্লায় গিয়ে বেকার থাকেননি তিনি। জড়িত হন ই-কমার্সের সঙ্গে।
তিনি জানান, অনলাইনের বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে খাদি পাঞ্জাবি বিক্রি করছি। পাঞ্জাবির ছবি ফেসবুকে দিয়ে যদি কারও পছন্দ হয় তাহলে ইনবক্স কিংবা ফোন নিশ্চিত করেন। অর্ডার পেলে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেই।
ফেসবুকভিত্তিক সবচেয়ে বড় ই-কমার্স প্লাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই)। ১১ লাখের মতো সদস্য রয়েছে এই গ্রুপে। সেখানে কয়েক হাজার উদ্যোক্তা রয়েছেন। তাদের একজন জান্নাতুল ফেরদৌস হ্যাপি। রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে গাজীপুর থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে ই-কমার্স প্লাটফর্মে যুক্ত আছেন।
তার ই-কমার্স প্লাটফর্ম নুকি শপ থেকে পাবনার ১০০ শতাংশ খাঁটি ঘি নিয়ে পুরো বাংলাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। তিনি জানান, পাবনার মেয়ে হলেও আমার শ্বশুর বাড়ি গাজীপুর এবং সেখানেই থাকেন। কাজ করছেন নিজের জন্মস্থান পাবনা জেলার বিখ্যাত পণ্য পাবনার খাঁটি ঘি নিয়ে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, করোনাকালে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে ই-কমার্স ব্যবসা। গত বছরের লকডাউনে টানা সাধারণ ছুটিতে ঘরবন্দি ভোক্তার দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ই-কমার্স খাত। এ বছরও লকডাউনে ই-কমার্স খাতের গুরুত্ব নতুন করে অনুধাবিত হয়।
মূল পেশা হিসেবেও ই-কমার্সে ঝুঁকেছেন অনেকেই। তাদের একটা বড় অংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণী, যারা নতুন উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা করছে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠিত অনেক উদ্যোক্তাও তাদের ব্যবসা প্রসারের জন্য ই-কমার্সে ঝুঁকেছেন। অনেক ছাত্রী অবসরে তাদের হাতে বানানো খাবার-পোশাক বিক্রি করে জানান দিচ্ছেন নিজেদের প্রতিভার। সাধারণত অনলাইন ব্যাংকিং, বিকাশ, নগদ অ্যাপস্ ব্যবহার করে এই ব্যবসায় পণ্যের দাম পরিশোধ হয়। অনেকে আবার হাতে হাতেও করে থাকেন লেনদেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী মোবাশশিরা দিদার আদিবা। গত বছর করোনার প্রদুর্ভাব শুরু পর ‘The Sterling Zone’ নামে ফেসবুক পেজ থেকে শুরু করেন ই-কমার্স প্লাটফর্ম। এখান থেকে গ্রোসারি ও হোম মেইড ফুড (ঘি, মধু, সরিষার তেল, নারিকেল তেল, সস, সয়া, কিশমিশ, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, মিক্সড ফ্রুটস ইত্যাদি) ঘরে বসেই কিনতে পারবেন ক্রেতারা।
উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা কিভাবে তৈরি হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনায় অবসর সময়কে কাজে লাগানো ও পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করার উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা দুই বোন ঘরে থাকা কিছু দুধ নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। প্রথমে মিষ্টি, দই, মজারেলা চিজ, ঘি নিয়ে শুরু করি। তবে ডেলিভারি সমস্যার কারণে মিষ্টি ও দই বাদ দেই। এখন ২৫টির ওপর পণ্য নিয়ে কাজ করছি। ভবিষ্যতে একে সুপারশপে রূপান্তর করার ইচ্ছা আছে আমাদের।
তিনি আরও বলেন, চাকরি করা কখনোই পছন্দ ছিল না। নিজের ব্যবসায়ে নিজের স্বাধীনতা আর সৃজনশীলতা দুইটাই আছে। তাই ক্যারিয়ার হিসেবে বিজনেসকেই বেছে নিতে চাই।
শাড়ি, পাঞ্জাবি ও ফার্নিচার নিয়ে ঢাবির গণিত বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের ইমতিয়াজ উদ্দিন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তার বড় ভাই মিলে শুরু করেন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম কালিভার্ড। ইমতিয়াজ বলেন, বড় বড় কোম্পানির চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে নিজেরও সব সময় মনে হতো, আমিও যদি চাকরির এমন বিজ্ঞাপন দিতে পারতাম। এতে নিজে কিছু একটা করে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতাম। আর অনেকগুলো পরিবার এর মুখে হাসি ফোটাতে পারতাম। আলহামদুলিল্লাহ, এখান আমাদের প্রতিষ্ঠানে এখন অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছে।’
ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে এসে কি কি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ই-কমার্স ব্যবসায় কুরিয়ার এখনো বড় চ্যলেঞ্জ। মাঝে মাঝে কুরিয়ার প্রোডাক্ট হারায়ে ফেলে, এক জায়গার প্রোডাক্ট অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। এর ফলে উদ্যোক্তা এবং ক্রেতার মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। ভোগান্তি তৈরি হয়।’
ক্যারিয়ার হিসেবে আগামীতে ই-কমার্সকেই বেছে নেবেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ক্যারিয়ার হিসেবে আগামীতে ই-কমার্সকেই বেছে নেবো। ই-কমার্স ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হবে, এ ব্যবসার ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। কারণ বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আপনাকে অবশ্যই কোন না কোন সময় এটার দ্বারস্থ হতে হবে। যদি ভবিষ্যতে এটির দ্বারস্থ হতেই হয় তাহলে ই-কমার্স শুরু করতে দেরি কেন। একটা প্রতিষ্ঠান ভালো একটা স্থানে দাঁড় করাতে হলে সেটির প্রস্তুতি আগে থেকেই নেওয়া উত্তম বলে মনে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশসহ বিশ্বের সকল পণ্যই এখন অনলাইনের মাধ্যমে ক্রয় করা সম্ভব। অনলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন অনেক পরিমাণে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে। যাই হোক সকল বিষয় বিবেচনা করে এটা বলা যেতেই পারে, এটির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ক্রেতাদের একটা বড় অংশের অনলাইনে কেনাকাটার অভিজ্ঞতা ছিল না। করোনাকালে তাঁরা অনলাইনে পণ্য কিনেছেন। ফলে অভ্যস্ততা তৈরি হয়েছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে তাঁদের একটা অংশ অনলাইনের ক্রেতা হিসেবে থাকবেন।’
ঢাবির ২০১৮-১৯ সেশনের কারুশিল্প বিভাগের ছাত্রী হুমায়রা আনজীর। ব্যাসার্ধ (Beshardho) নামক ফেসবুক পেজ থেকে শুরু করেন ই-কমার্স প্লাটফর্ম। কাজ করছে হাতে তৈরি গয়না, মেয়েদের পোশাক, শৌখিন ডায়েরি, কাঠের আয়না ইত্যাদি নিয়ে। ঘরে বসেই এসব পণ্যে কিনতে পারবেন ক্রেতারা।
তিনি বলেন, ‘মূলত নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার চিন্তা থেকেই এ পথ বেছে নেওয়া। ক্যারিয়ার হিসেবে আগামীতে ই-কমার্সকেই বেছে নিতে চাই কারণ এর মাধ্যমে আমি আত্নকর্মসংস্থান এবং আরও কয়েকজন মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবো।’
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জুলেখা খাতুন ঝুমুর। পড়াশোনার পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে জড়িত রয়েছেন। তিনি বলেন, ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ এবং বিভিন্ন ই-কর্মাস প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়ে আমার এই ক্ষুদ্র ব্যবসাটাকে আস্তে আস্তে প্রসারিত করার পরিকল্পনা করছি।