দুশ্চরিত্রের ভয়াবহ পরিণতি

  © সংগৃহীত

মানবজীবনে চরিত্রই হলো তার আসল পরিচয়। একজন মানুষের আসল মূল্যায়ন তার কথাবার্তা, আচরণ এবং নৈতিকতা দ্বারা নির্ধারিত হয়। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তি সৎ চরিত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে দুশ্চরিত্রে লিপ্ত হয়, তখন তার ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক মর্যাদা এমনকি আখিরাতও চরম হুমকির মুখে পড়ে। দুশ্চরিত্রতা শুধু একজন ব্যক্তির নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য এক মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে বিবেচিত। ইসলামে যেমন উত্তম চরিত্রের ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তেমনি দুশ্চরিত্রের জন্য রয়েছে ভয়াবহ পরিণতির সতর্কতা।

ইসলামে উত্তম চরিত্রের প্রতি অনেক বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বিভিন্ন ফজিলতের ঘোষণা দিয়ে আখলাকে হাসানা বা উত্তম চরিত্র অর্জনে উৎসাহিত করেছে। আবার ইসলাম বিভিন্ন মন্দ পরিণতি ও শাস্তির কথা উল্লেখ করে অপছন্দনীয় ও নিন্দিত স্বভাব বর্জনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কারণ, ব্যক্তির মন্দ স্বভাব তার জান্নাত হারানোর অন্যতম কারণ।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে যাবে না।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮০১)। মন্দ স্বভাবের লোকের জন্য তো এই একটি হাদিসই যথেষ্ট যে, তার লালিত মন্দ স্বভাব জান্নাতে প্রবেশের অন্যতম বাধা হবে।

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা কি জান অভাবী কে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমাদের মধ্যে তো সেই অভাবী যার টাকা-কড়ি ও অর্থ-সম্পদ নেই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমার উম্মতের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে বেশি অভাবী হবে, যে দুনিয়াতে নামাজ, রোজা, জাকাত আদায় করে আসবে এবং পাশাপাশি সেই লোকরাও আসবে, যাদের কাউকে সে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, কারও সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, কাউকে হত্যা করেছে, কাউকে আবার মেরেছে। সুতরাং এই ব্যক্তিকে (নামাজ-রোজা নিয়ে আগমনকারী) তার নেকি দেওয়া হবে। এরপর সে ওই হকদারদের (যাদের ওপর সে বিভিন্নভাবে জুলুম করেছিল) তার নেকি বদলা হিসেবে দেওয়া হবে। এভাবে পরিশোধ করতে গিয়ে যদি তার নেকি শেষ হয়ে যায়, তবে তাদের (হকদারের) গুনাহগুলো ওই ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (মুসলিম, হাদিস : ৪৯০০; মিশকাত, হাদিস : ৯/১৮৪)

ব্যক্তির মন্দ চরিত্র কীভাবে তাকে নাজেহাল করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে, হাদিসটি তার বাস্তব চিত্র। সে আমলকারী কতই না হতভাগা, যে আমল করেছে; কিন্তু বাজে অভ্যাসগুলো ছাড়তে পারেনি। ফলে এই অভ্যাসগুলো তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করে ছেড়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (মিশকাত, হাদিস : ৪৬১২; ৯/৮০)।

যেসব ব্যক্তি নিজের স্বার্থের জন্য সত্য ও ন্যায়কে পাশ কাটিয়ে পরিস্থিতির অনুকূলে কথা বলে, তাদের সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন ওই ব্যক্তিকে তোমরা সর্বাধিক মন্দ অবস্থায় পাবে, যে দ্বিমুখী। সে এক মুখ নিয়ে এদের কাছে আসে, আরেক মুখ নিয়ে ওদের কাছে যায়।’ (মিশকাত, হাদিস : ৪৬১১,৯/৮০)।

রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘উপকার করে খোঁটা দানকারী, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান ও সর্বদা মদপানকারী জান্নাতে যাবে না।’ (মিশকাত, হাদিস : ৪৭১৬,৯/১১৯; নাসায়ি, হাদিস : ৫৬৭২, সনদ সহিহ)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুমিন হয় সরল ও ভদ্র, পক্ষান্তরে পাপী হয় ধূর্ত ও দুশ্চরিত্রের।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৭৯০)।

রাসুল (সা.) অন্যত্র বলেন, ‘আমি কি তোমাদের জাহান্নামবাসীদের সম্পর্কে সংবাদ দেব না? তারা হচ্ছে অনর্থক কথা নিয়ে বিবাদকারী, বদ মেজাজি, অহংকারী।’ (মুত্তাফাক আলইহি)।

মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে ‘তারা হচ্ছে বদ মেজাজি, কুখ্যাত, অহংকারী।’ (মিশকাত, হাদিস : ৪৮৮৯,৯/১৭৬)।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিরা আমার নিকট ঘৃণ্য ও কিয়ামতের দিন আমার নিকট থেকে দূরে অবস্থান করবে, যারা বাচাল, নির্লজ্জ ও মুতাফাইহিকুন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, বাচল ও নির্লজ্জ তো বুঝলাম; কিন্তু মুতাফাইহিকুন কারা, হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বলেন, ‘অহংকারীরা।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২০১৮)।

কোনো মানুষের গঠন-আকৃতি, পোশাক-পরিচ্ছদ ভালো না হলে এবং তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে তাকে হেয় করা উচিত নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ইমানদাররা! পুরুষরা যেন পুরুষদের ঠাট্টা না করে। হতে পারে (যাদের ঠাট্টা করা হচ্ছে) তাদের মধ্যে এদের চেয়ে উত্তম লোক আছে। আর নারীরা যেন নারীদের ঠাট্টা-বিদ্রƒপ না করে। হতে পারে তাদের মধ্যে এদের চেয়ে ভালো লোক আছে।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১১)।

রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার ভাইকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ মনে করে।’ রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির সঙ্গে ঝগড়া করব। ১. যে আমার সঙ্গে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে। ২. যে ব্যক্তি কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করে। ৩. যে ব্যক্তি কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে কাজ আদায় করে, কিন্তু তার মজুরি পরিশোধ করে না।’ (বোখারি, হাদিস : ৪/৯১

কিয়ামতের দিন ওয়াদা খেলাফকারীর জন্য তার ওয়াদা খেলাফের মাত্রা অনুযায়ী দুই নিতম্ব বরাবর পতাকা উত্তোলন করা হবে। আর বলা হবে এটি অমুকের ওয়াদা খেলাফের পতাকা। (বোখারি, হাদিস : ১৫৮৫)।

কোনো মানুষকে বিনা কারণে কষ্ট দেওয়া ও তার দোষ খোঁজা মন্দ স্বভাব। এর পরিণতিও অশুভ ও মন্দ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা মুমিন নর-নারীকে বিনা অপরাধে কষ্ট দেয়, তারা অতি বড় মিথ্যা দোষ ও জঘন্য পাপের শাস্তি তাদের নিজেদের ঘাড়ে চাপিয়ে নেয়।’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ৫৮)।

আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়াও মন্দ স্বভাব। এর শাস্তি হিসেবে আল্লাহ তার সহচর হিসেবে একজন শয়তান নিয়োগ করে দেন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘যে ব্যক্তি দয়াময় আল্লাহর স্মরণে বিমুখ হয়, আমি তার জন্য নিয়োগ করি এক শয়তান। আর সে হয় তার বন্ধু।’ (সুরা জুখরুফ, আয়াত ৩৬)।

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে আমার স্মরণে বিমুখ, তার জীবন হবে সংকুচিত এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় ওঠাব। সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় ওঠালেন? আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন।’ (সুরা ত্বহা, আয়াত : ১২৪-১২৫)।

মানুষের মন্দ স্বভাবের পরিণতির কথা যৎসামান্যই এখানে উদ্ধৃত হলো। তবে হাদিসগুলো থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তির মন্দ স্বভাব, চাই তা কাউকে হত্যা করার মতো জঘন্য অপরাধ হোক কিংবা বদ মেজাজের মতো ব্যক্তিগত দোষই হোক পরিণামে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জাহান্নামের দিকে ধাবিত হয়। তার কাজ তাকে নিয়ে যায় তাকে কঠিন শাস্তির দিকে।

চরিত্রের কলুষতা মানুষকে ধীরে ধীরে আত্মিকভাবে ধ্বংস করে দেয় এবং সমাজে অরাজকতা ও অনৈতিকতার বিস্তার ঘটায়। দুশ্চরিত্র ব্যক্তি যেমন নিজের শান্তি হারায়, তেমনি অন্যদের জীবনকেও বিষিয়ে তোলে। তাই নিজেকে পরিশুদ্ধ রাখা, ভালো চরিত্র গঠন করা এবং দুশ্চরিত্রতা থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানি দায়িত্ব। আসুন, আমরা সবাই নিজেকে সংশোধন করি, সুন্দর চরিত্র গঠনে সচেষ্ট হই এবং আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি যেন দুনিয়া ও আখিরাতে নিরাপদ থাকতে পারি।


সর্বশেষ সংবাদ

X
APPLY
NOW!