ইতিহাস-ঐতিহ্যের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পা দিল ১৭তম বর্ষে

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

১৮৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রাহ্ম পাঠশালাটি। সেই ব্রাহ্ম পাঠশালা থেকে জগন্নাথ স্কুল, এরপর জগন্নাথ কলেজ। রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় নানা ইতিহাস ও ঐহিত্যকে সঙ্গী করে প্রাচীন সেই পাঠশালাটি আজ দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ- জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫’ জারির মাধ্যমে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর থেকে চালু হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) কার্যক্রম। তাই সাধারণত ২০ অক্টোবরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করা হয়। কিন্তু এবার একই দিনে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) ও লক্ষ্মীপূজার ছুটি থাকায় ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হবে আগামীকাল ২১ অক্টোবর।

আর করোনা মহামারীর কারণে গত বছরের মতো এ বছরও স্বল্প পরিসরে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে স্বল্প পরিসরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও ভার্চ্যুয়ালি আলোচনা সভার আয়োজন করা হবে।

সেই পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথটা মসৃণ ছিল না মোটেই। আর এই দীর্ঘ যাত্রায় পুরান ঢাকার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সাক্ষী হয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার। নিজেও হয়েছে কোন কোন ইতিহাসের অংশ।

মানিকগঞ্জ জেলার বালিয়াটির তৎকালীন জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ১৮৬৮ সালে তার পিতার নামে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম স্কুলের নামকরণ করেন জগন্নাথ স্কুল। পরে ১৮৮৪ সালে স্কুলটি জগন্নাথ কলেজে (দ্বিতীয় শ্রেণির) রূপ নেয়। ১৯০৮ সালে উন্নীত হয় প্রথম শ্রেণির কলেজে। প্রতিষ্ঠার সময় জগন্নাথ কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিল মাত্র ৪৮ জন। কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে প্রথম দায়িত্ব পালন করেন শ্রীকুঞ্জ লাল নাগ (১৮৮৪-১৮৯৫)।

পরবর্তীতে একটি দলিলের মাধ্যমে ১৯০৭ সালের ১ মার্চ কলেজ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ট্রাস্টি বোর্ডকে। সেই বোর্ডের সদস্য হন কিশোরীলাল রায় চৌধুরী, রায়চন্দ্র কুমার দত্ত বাহাদুর ও আনন্দচন্দ্র রায়। ১৩ বছর পর জগন্নাথ কলেজ অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নম্বর ১৯২০ এর ১৬) পাস হলে ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে গঠন করা হয় গভর্নিং বডি, যার প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালের ২০ আগস্ট।

জগন্নাথ কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয় ১৯৩৫ সালের ২০ মার্চ। সন্তোষের মহারাজা মন্মথ রায় চৌধুরী এতে সভাপতিত্ব করেন। সেসময় বিএসসি (ব্যাচেলর অব সায়েন্স), বিকম (ব্যাচেলর অব কমার্স), বিএ (ব্যাচেলর অব আর্টস) ডিগ্রি কোর্সসহ সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

পুরান ঢাকায় নারী শিক্ষার অগ্রগতির জন্য ১৯৪২ সালে জগন্নাথ কলেজে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়। কলেজটি সম্পূর্ণভাবে সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয় ১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট।

সময়ের পরিক্রমায় ২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষার্থী ভর্তি শুরু করে সেই জগন্নাথ কলেজ। তবে ২০০১-০২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাই প্রথম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা সনদ লাভ করেন। চারটি অনুষদ, ২২টি বিভাগ আর প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির। তখন প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান।

বর্তমানে ৭.৫ একর জমির ওপর মোট ১১টি ভবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি শহীদ মিনার এবং ‘একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ নামে একটি স্মারক ভাস্কর্য। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদ, ৩৬টি বিভাগ ও দুটি ইনস্টিটিউট (আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট এবং শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) রয়েছে। ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব’ নামে একটি আবাসিক ছাত্রী হল, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য নিজস্ব পরিবহন সুবিধা, চিকিৎসার জন্য একটি মেডিকেল সেন্টার রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ অবস্থিত ধুপখোলায়।

নতুন ক্যাম্পাস:

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আবাসনসহ নানা ধরনের সমস্যা সমাধানে কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস স্থাপনে ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নের জন্য প্রকল্পে এক হাজার ৯২০ কোটি ৯৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকার প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দিয়েছে ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আলোকসজ্জা

আন্দোলন-সংগ্রামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়:

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল করা হলে ২৬ ফেব্রুয়ারি সর্বপ্রথম মিছিলে অংশগ্রহণ করেন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধসহ সব জাতীয় সংগ্রামে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

ভাষা আন্দোলনে সর্বপ্রথম শহীদ হন তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমদ। তার স্মরণে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি একাডেমিক ভবনের তার নামে নামকরণ করা হয়। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রকাশিত প্রথম পুস্তিকা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’র লেখক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।

জগন্নাথের উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ) যেসব শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দেশ গড়ার কাজে অবদান রেখেছেন তারা হলেন, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ, কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়া সাঁতারু ব্রজেন দাস, বাঙালি কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন, শিক্ষক হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শওকত আলী, বিক্রমপুরের ইতিহাস খ্যাত লেখক শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, গবেষক গোলাম মুরশিদ ও মির্জা হারুন-অর রশিদ, লেখক ও দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দীন আহমেদ রাজু, প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বিশারদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ, শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ইতিহাসবিদ ড. মাহমুদুল হাসান, অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত, লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ. আর. ইউসুফ, গায়ক ফকির আলমগীর, কিরণ চন্দ্র রায়, সাংবাদিক রাহাত খান, আ ন ম বজলুর রহমান, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, সঙ্গীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, ড. শামসুজ্জামান খান, হায়াৎ মাহমুদ, অভিনেতা এ. টি. এম. শামসুজ্জামান প্রমুখ।

বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৬৫৭ জন শিক্ষক, ১৪ হাজার ২০৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এছাড়া সাতটি শিক্ষাবর্ষে ২১৪ জন শিক্ষার্থী এমফিল ও ৮৭ জন পিএইচডি করছেন।

সহশিক্ষা কার্যক্রম:

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের  সংগঠন, নেতৃত্ব বিকাশ ও বিভিন্ন দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ, ক্যারিয়ার ক্লাব, সায়েন্স ফিকশন সোসাইটি, রঙ্গভূমি (জবি রঙ্গ), মাইম সোসাইটি, ডিবেটিং সোসাইটি (জেএনইউডিএস), রোভার স্কাউটস, রেঞ্জার ইউনিট, আইটি সোসাইটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী জবি, বিএনসিসি, আবৃত্তি সংসদ, ফিল্ম ক্লাব, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, বাঁধন ইত্যাদি। এসব সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার গঠনে নিজেকে অনন্য করে তুলতে পারেন।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ ইমদাদুল হক বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিতে আমি কাজ করছি। আমরা গবেষণা খাতে গতবারের চেয়ে বাজেট ডাবল করে দিয়েছি। একই সাথে লাইব্রেরি, আইসিটি, কম্পিউটার কেনা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাজেট বাড়ানো হয়েছে। আমি উপাচার্য হয়ে আসার সাথে সাথে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও গবেষণা শিল্প পরিষদ (বিসিএসআইআর) এর সাথে চুক্তি করেছি, যাতে আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সহজে গবেষণা করতে পারে। আমরা শীঘ্রই পরমাণু শক্তি কমিশন, ঢাবি ও বুয়েটের সাথে চুক্তি করবো।

উপাচার্য বলেন, আমরা করোনাকালীন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধকোটি টাকা স্কলারশিপ দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার জন্য টিকা কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করেছি এবং এই কোভিডের সময়েও গত ঈদে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব পরিবহনে বাসায় পৌঁছে দেয়া হয়েছে। সর্বোপরি যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হয় এবং এটা একটা পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয় সেই প্রত্যাশা রেখে কাজ করে যাবো।


সর্বশেষ সংবাদ