১৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা, ব্যাহত শিক্ষাকার্যক্রম

সরকারি লোগো
সরকারি লোগো  © ফাইল ছবি

প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পার করলেও রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবিপ্রবি) স্থায়ী কোনো ভবন নির্মাণ হয়নি। ২০০১ সালের ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদে ‘রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ পাস হওয়ার পর ২০১৪ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এরপর এক দশক পার হলেও স্থায়ী ভবন নির্মাণ করা যায়নি। প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়লেও নির্মাণ করা যায়নি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। নানান সংকটে ভোগা বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে অস্থায়ী ভবনে। শিক্ষা কার্যক্রমে ঘটছে ব্যাঘাত।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) তিনটি প্রকল্পের কাজ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে চার বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ তলাবিশিষ্ট শেখ হাসিনা হল, ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ভবন এবং স্বাধীনতা স্মারক- এ তিন প্রকল্পের নকশা ও পরামর্শক পরিবর্তন এবং নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে নতুন করে বরাদ্দের আবেদন জানানোর পর দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ইউজিসি নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। হল না থাকায় শিক্ষার্থীদের বাইরের মেসে থাকতে হচ্ছে। ব্যয় হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ১২ হাজার বর্গমিটারের নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ, অধ্যাপক থেকে শুরু করে প্রভাষক পর্যন্ত শিক্ষকদের থাকার জন্য ১০তলা বিশিষ্ট দুটি ডরমেটরি, গবেষণার জন্য কেন্দ্রীয় গবেষণাগার, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ তলা বিশিষ্ট একটি ডরমেটরি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি।

শুধু এ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়; নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন না করতে পারা, অনিয়ম, প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দেশের অন্তত ১৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত একাডেমিক ভবন না থাকা ও হলের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজগুলো দ্রুত শেষ করার তাগাদা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, অ্যাকাডেমিক ভবন না থাকায় এক বিভাগের শিক্ষার্থীদের অন্য বিভাগে ক্লাস করতে হচ্ছে। আবাসিক হলের সংকটে শিক্ষার্থীদের মেসে থাকতে হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। গবেষণা সরঞ্জামাদি, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির অভাবে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না। এসব সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার তাগাদা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে রুয়েটের ‘ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মাইনুর রহমান বলেন, আবাসিক হল, একাডেমিক ভবন নির্মানের কাজগুলো অনেক ধীর গতিতে হচ্ছে। আমরা চাই, হলগুলোর কাজ দ্রুত শেষ করা হোক। আবাসন সংকট থাকায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে থাকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, এরপরের সিরিজের কোনো শিক্ষার্থী যাতে এ সমস্যার সম্মুখীন না হয় প্রশাসনকে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা দূর থেকে রুয়েটে পড়তে আসে তাদের বাইরে বাসা বা মেস ভাড়া করে থাকা, খাওয়ার সমস্যা হবে না। ‘

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ‍ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) সৈয়দ মামুনুল আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পট পরিবর্তনসহ নানা কারণে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ থমকে আছে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প রিভাইজড ও রিসিডিউল হয়েছে। সেজন্য কাজ শুরু হতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। স্থগিত হওয়া কাজগুলো যেন দ্রুত শেষ করা হয় আমরা সেই চেষ্টা করছি। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) ১২ হাজার বর্গমিটারের নতুন একাডেমিক ভবন নির্মাণ, অধ্যাপক থেকে শুরু করে প্রভাষক পর্যন্ত শিক্ষকদের থাকার জন্য ১০তলা বিশিষ্ট দুটি ডরমেটরি, গবেষণার জন্য কেন্দ্রীয় গবেষণাগার, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আন্তর্জাতিক এবং মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের জন্য ৫ তলা বিশিষ্ট একটি ডরমেটরি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়নি।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজে ধীরগতির অভিযোগ ছিল। এ কারণে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প উন্নয়নের কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে তদারক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। কাজ সমাপ্ত করতে অর্থ বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আন্তঃখাত সমন্বয় করে চুয়েটের অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। 

‘উন্নয়ন প্রকল্পগুলো রিসিডিউল, রিভাইজ করার কারণে কাজে কিছুটা স্থবিরতা এসেছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক ভবন এবং হল নির্মাণের কাজে স্থবিরতা রয়েছে, সেগুলোর প্রকল্প যেন দ্রুত অনুমোদন করা হয়, আমরা সেই চেষ্টা করছি। কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজে ফাঁকি দিলে তাদের বিরুদ্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে—সৈয়দ মামুনুল আলম, অতিরিক্ত সচিব মাধ্যমিক ‍ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ

উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি না হওয়া আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট)। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রুয়েটে ১০ তলা বিশিষ্ট নতুন একটি একাডেমিক ভবন, শিক্ষকদের জন্য ১০ তলা বিশিষ্ট দুইটি আবাসিক ভবন, ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন কেন্দ্র, গবেষণার যন্ত্রপাতি ক্রয়ে উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল। তবে দেড় বছর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে  কোনো উপাচার্য না থাকায় উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ ছাড় করা সম্ভব হয়নি।

এ ছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিডিসির দায়িত্বহীনতার কারণে বিওকিউ’র প্রতিফলন হয়নি। এর ফলে ‘বাজেটারি অ্যালোকেশন’র সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলশ্রুতিতে আন্তঃখাত (এক খাতের জিনিস আরেক খাতে দেওয়া) সমন্বয় করতে হয়েছে। এতে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি। অ্যাকাডেমিক ভবন এবং গবেষণার পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকায় শিখন ঘাটতিতে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। 

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিভাসু) ঢাকাস্থ পূর্বাচলে ৯তলা বিশিষ্ট পেট হসপিটাল নির্মাণ কাজ শুরু হলেও হাসপাতালটি পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া কক্সবাজারে শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য পাঁচতলা বিশিষ্ট ডরমেটরিও নির্মাণ হয়নি। এছাড়া বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি এবং গবেষণা সরঞ্জামাদিও ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের বাস্তবিক জ্ঞান অর্জনে ব্যাঘাত ঘটছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিভাসুর উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়েছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের কারণে। নওফেলের বিদ্বেষে রিভাইজড ডিপিপি আন্তঃখাত করা হয়। তবে ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর নতুন করে প্রকল্পের অনুমোদন নিতে ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে সিভাসুর উন্নয়ন প্রকল্প সমাপ্ত করতে কেন দেরি হয়েছে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়। 

উন্নয়ন প্রকল্প থমকে রয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরও। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির ২০ তলা বিশিষ্ট অ্যাকাডেমিক ভবন এবং ১০ তলাবিশিষ্ট দুটি হল নির্মাণের কাজ থমকে রয়েছে বলে জানা গেছে। ভবন নির্মাণের সময় এক শ্রমিকের মৃত্যু এবং একটি ভবনের বিম ধসে পড়ায় কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়েরও উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে ডিডিসি। একাডেমিক ভবন না থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে ভোগান্তি হচ্ছে। অন্যদিকে আবাসিক হলে সিট না পেয়ে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের মেসে থাকতে হচ্ছে। অবিলম্বে নতুন হল নির্মাণের কাজ শেষ করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

এছাড়া গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজও স্থবির হয়ে পড়েছে।

সার্বিক বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মামুনুল আলম জানান, ‘উন্নয়ন প্রকল্পগুলো রিসিডিউল, রিভাইজ করার কারণে কাজে কিছুটা স্থবিরতা এসেছে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক ভবন এবং হল নির্মাণের কাজে স্থবিরতা রয়েছে, সেগুলোর প্রকল্প যেন দ্রুত অনুমোদন করা হয়, আমরা সেই চেষ্টা করছি। কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজে ফাঁকি দিলে তাদের বিরুদ্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।’


সর্বশেষ সংবাদ