জাকির নায়েককে ফেরত চেয়েছে ভারত
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২০, ১০:২২ AM , আপডেট: ১৯ জুন ২০২০, ১০:২২ AM
আলোচিত ইসলামী বক্তা জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে ভারতে সবশেষ অভিযোগ উঠেছে, গত ফেব্রুয়ারির রায়টে ইন্ধনদাতা এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছেন৷ ফলে নতুন দিল্লি তাকে ফেরত দিতে কুয়ালালামপুরের কাছে আহবান জানিয়েছে৷
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য কুইন্ট বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে পুলিশের একটি আবেদনের ভিত্তিতে বলেছে, খালিদ সাইফি নামের এক গত ফেব্রুয়ারির দিল্লি রায়টের সন্দেহভাজন ইন্ধনদাতার সঙ্গে দেশের বাইরে সাক্ষাৎ করেছিলেন৷ সাইফি তার ‘এজেন্ডা ছড়িয়ে দিতে' নায়েকের সহযোগিতা চেয়েছিলেন৷ গত ১৫ জুন এই আবেদন দাখিল করে পুলিশ৷
এর আগে গত ১৪ মে ভারত নায়েককে মালয়শিয়ার কাছ থেকে ফেরত চায়৷ রক্ষণশীল এই ভারতীয় ইসলাম প্রচারক তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটিতে নির্বাসিত আছেন৷ সেখানে তার স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি রয়েছে৷
জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে৷ সবচেয়ে বড় অভিযোগটি প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের৷ এছাড়া নানা সময়ে তার বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কথা বলার অভিযোগ রয়েছে৷ তবে সব অভিযোগই অস্বীকার করে এসেছেন তিনি৷
২০১৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় হলি আর্টিজানের ঘটনায় হামলাকারীদের দু’জন নিব্রাস ইসলাম ও রোহান ইমতিয়াজ তার বক্তব্যের দ্বারা প্রভাবিত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে৷ তবে এই অভিযোগও তিনি বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন৷
এ ঘটনার পর তার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর পড়ে৷ সে বছরই ভারত ও বাংলাদেশে তার মালিকানাধীন পিস টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়৷ এরপরপরই তার বিরুদ্ধে আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর অভিযোগ আনা হয়৷ ভারতীয় কাউন্টারটেররিজম এজেন্সি নায়েকের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ আনে৷ জাকির পালিয়ে যান মালয়শিয়ায়৷
২০১৬ সালের ১ জুলাই শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে ঢাকার গুলশান দুই-এর ৭৯ নম্বর সড়কের পাঁচ নম্বর বাড়ির হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা হয়৷ তিনি ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইআরএফ)-এর প্রধান৷ দুবাই থেকে এই ফাউন্ডেশনের অধীন পিস টিভি প্রচারিত হয়৷ সারাবিশ্বে এই চ্যানেল দর্শক প্রায় ২০ কোটি৷
মালয়শিয়ায় আসার পর থেকে জাকিরের আইআরএফ কাতার, তুরস্ক ও পাকিস্তান থেকে অর্থ পাচ্ছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে৷ তবে এমন সময় এই রিপোর্টগুলো প্রকাশিত হয়েছে যখন ভারতে মুসলিমদের প্রতি আচরণ নিয়ে তুরস্ক, পাকিস্তান ও মালয়শিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করছিল৷
এ বিষয়ে মার্কিন এনজিও ফেয়ার অবজারভারের প্রতিষ্ঠাতা অতুল সিং বলেন, ‘মালয়শিয়া, তুরস্ক ও পাকিস্তান আধুনিক ইসলামিক রাষ্ট্র৷ তারা ইসলামের সঙ্গে ব্যবসা, বিজ্ঞান ও অর্থনীতির সংযোগকে গুরুত্ব দিচ্ছেন৷ তারা জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না৷ কারণ সবকিছুর পরও ইসলামেরই প্রচারণা করছেন জাকির৷’
অনেকে মনে করেন, নায়েক মালয়শিয়া, তুরস্ক ও পাকিস্তানের ভেতরে ঐক্য তৈরিতে ভুমিকা রাখতে পারেন৷ ‘ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে তুরস্ক ও পাকিস্তান৷ শেষ পর্যন্ত ইসলাম দিয়েই তুরস্ক, পাকিস্তান ও মালয়শিয়া নিজেদের মধ্যে বন্ধনটা বজায় রাখতে চাইছে,’ তুরস্কের আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টার টিআরটি ওয়ার্ল্ডের গবেষক হাজিরা মারিয়াম বলেন৷
ভারত বারবার চেষ্টা করেও জাকিরকে ফেরত আনতে পারছে না৷ ইন্টারপোল তাদের রেডনোটিশ জারির অনুরোধ তিনবার ফেরত দিয়েছে৷ ‘ভারত নায়েককে ফেরত চায় কারণ তিনি ভারতের একটি নেতিবাচক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেছেন৷ ভারতের তরুণ মুসলিমদের ওপর নায়েকের প্রভাব নিয়েও চিন্তিত নতুন দিল্লি৷ ভারতে বেশ কয়েকটি ‘স্লিপার আইএস সেল’ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যারা তার দ্বারা অনুপ্রাণিত,’ বলেন জিন্দাল স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের ডিন শ্রীরাম চাউলিয়া৷
এর আগেও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আল-কায়েদার বেশ কয়েকজন অনুসারী নায়েক দ্বারা অনুপ্রাণিত বলে স্বীকার করেছেন৷ এছাড়া জিহাদ, হিন্দুত্ববাদ ও নারীর অধিকার নিয়ে তার চিন্তাধারা নিয়ে ভারতে সমালোচিত তিনি৷
অতুল সিং বলেন, ‘জাকির নায়েক বিশ্বাস করেন পুরুষ তাদের স্ত্রীদের হালকা প্রহার করতে পারেন এবং তারা তাদের দাসীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করার অধিকার রাখেন৷’ তিনি যোগ করেন, ‘একটা পর্যায়ে এসে আপনাকে প্রত্যেক মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়াতে হবে৷ জাকির নায়েককে কোন প্লাটফর্ম নয়, জেল দেয়া উচিত৷’
জাকির নায়েককে ভারতের ফেরত চাওয়ার সঙ্গে দেশটির সরকারের হিন্দু-জাতীয়তাবাদের এজেন্ডা আছে কিনা এমন প্রশ্নও অবশ্য তোলা হয়েছে৷ ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের আপীল বিভাগের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ ট্রাইবুনালের বিচারক মনমোহন সিং বলেছিলেন, জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো তৎপরতা দেখিয়েছে, তেমন তড়িৎ ব্যবস্থা অপরাধে অভিয্ক্তু প্রভাবশালী হিন্দু গুরুদের বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি৷
পাকিস্তানের জিও নিউজের গবেষক ও সেন্ট্রাল পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যায়ের ভিজিটিং প্রফেসর নাইম বালোচ বলেন, ‘নায়েকের কাছে একবার ওসামা বিন লাদেনের জিহাদের আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সেই আদর্শের ঘোর বিরোধিতা করেন৷জাকির নায়েকের কোন রাজনৈতিক অভিলাষ আছে বলে মনে হয় না।’
ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে জাকির নায়েককে হয়ত ফেরত দেবে না মালয়শিয়া, বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা৷ ‘মালয়শিয়ার বর্তমান সরকার আগের চেয়ে অনেক বেশি ইসলামিক, তাদের ওপর প্যান মালয়শিয়ান ইসলামিক পার্টির প্রভাব রয়েছে,’ চাউলিয়া বলেন৷
লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কন্ট্রোল রিস্কসের গবেষক চাইয়ে শু ওয়েন বলেন, ‘রক্ষণশীল মালয় ভোটারদের কাছে নায়েক শুধু একজন ধর্ম প্রচারক৷ এরা বর্তমান জোট সরকারের জন্য ভোটব্যাঙ্ক৷ তাই নায়েককে ফেরত দেয়া মানে এদের সমর্থন হারানো৷’
আইনগতভাবেও মালয়শিয়ার কাছে সে সুযোগ আছে বলে মনে করেন নতুন দিল্লির আইনজীবী সৌরভ চৌধুরী৷ ‘মালয়শিয়া বলতে পারে, ভারতে নায়েককে যে গুরুত্ব দিয়ে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো করা হবে, যারা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপাচ্ছে, তাদের ঠিক সেভাবে বিচার করা হবে না,’ ব্যাখ্যা করেন তিনি৷
সূত্র: ডয়েচে ভেলে।