আইন শিক্ষা: ঢেলে সাজানোর চিন্তা করতে হবে

  © টিডিসি ফটো

মানব সমাজের সংগঠনের গোড়াতেই আইনের চিন্তা মানুষের মাথায় আসে। তারা প্রাকৃতিক আইনাবদ্ধও হয়ে উঠে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির সদগুণ যেমন ভালোবাসা, সহযোগিতা, স্নেহ, মায়া, মমতা ইত্যাদির পাশাপাশি কুপ্রবৃত্তির তাড়ায় মানুষ স্বার্থ, লোভ, ক্রোধ ইত্যাদির চর্চায় লিপ্ত হয়ে উঠে। ফলে যুথবদ্ধ জীবনে প্রয়োজন হয় কিছু নিয়ম-কানুন আর তা প্রয়োগের শক্তিমান সংগঠনের। শক্তিমান সংগঠনের বিকশিত রূপ আজকের রাষ্ট্র ব্যবস্থা। আবার রাষ্ট্রের ভিত্তিও আইন। আইন ও আইন অধ্যয়ন প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।

আইন ফারসী শব্দ যার অর্থ নিয়ম কানুন। ইংরেজি ‘ল’ (LAW)। ল্যাটিন ‘ল্যাগ’ (LAG) শব্দ থেকে ল শব্দটির উদ্ভব। ল্যাগ অর্থ স্থির। অনড়। আসলে আইন স্থির কিছুকে বুঝানোর জন্যই ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। বাকি আইন হলো: আইনসভা প্রবর্তিত আইন। আরও আছে অধ্যাদেশ, নির্বাহী বিভাগের আদেশ ও বিধিবিধান। এছাড়া, প্রথাগুলো এবং ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতিগুলোও সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষের জন্য আইনের সমকক্ষ।

আইন সম্পর্কে পঠন পাঠনের ইতিহাস মানবজাতির ইতিহাসের মতই পুরাতন। রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রদার্শনিকদের হাত ধরে এর অধ্যয়নের চেষ্টার শুরু। সেদিক থেকে আধুনিক আইন পাঠের পীঠস্থান প্রাচীন গ্রীস, রোম, ইংল্যান্ড। সেটা সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, হবস, হল্যান্ড, অস্টিন সবার হাত ধরেই এগিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের- মধ্যযুগের কোনো কোনো শাসনামলকে দেখা যায়, আইন পঠন পাঠনের উৎকর্ষতার যুগ হিসেবে। প্রাচ্যেও প্রাচীনকাল থেকেই আইন অধ্যয়নের আভাস পাওয়া যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র কিন্তু আইনের গ্রন্থও বটে।

বাংলাদেশে আইন পাঠ একটি মর্যাদাবান অধ্যয়ন শাখা। এটি সেই মুঘল আমলেও যেমন মর্যাদাপূর্ণ ছিল; ব্রিটিমদের হাতে তা আরও মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠে। উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের দেশ এটি পেয়েছে। আইন পাঠে দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দানের সুযোগ ব্রিটিশ আমলে শুরু। স্নাতক পর্যায়ে ২ বছর মেয়াদী পাঠ। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। নিম্ন আদালতে একপ্রকার নিম্নস্নাতক ডিপ্লোমাসম্পন্ন ‘মোক্তারগণ আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। আইন পাঠকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হিসেবে বা সমমানের ডিগ্রি হিসেবে গণ্য করাই দেশে দেশে প্রচলিত। এর আছে পাস কোর্স ২ বছর মেয়াদী। এখন এটি বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের তিন শতাধিক বেসরকারি আইন কলেজের মাধ্যমে পাঠ দানের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর সাথে আছে উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই সরকারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে স্নাতক সম্মান কোর্সে অধ্যয়নের সুযোগ যেখানে খুবই মেধাবীরা সুযোগ পায়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাস কোর্স পাঠের সুযোগ আছে। আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতকোত্তর পাঠের সুযোগ। এখন দেশে আইন পাঠ আরও বেশি মর্যাদা পায়।

আইনের মত একটি প্রয়োজনীয় পাঠ মানব চরিত্র গঠনে, সমাজ গঠনে এবং রাষ্ট্রগঠনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। প্রতিবছর কয়েক হাজার ল গ্রাজুয়েট তরুণ আইন ডিগ্রি সম্পন্ন করে বের হচ্ছেন। তারা সকল চাকুরিতে তো বটেই, বাংলাদেশের আইনাঙ্গনগুলো মুখরিত হচ্ছে তাদের পদচারণায়। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বিচারকের মর্যাপূর্ণ চাকুরি, অন্যান্য ভাল চাকুরি, প্রশাসন-পুলিশের চাকুরি, ল কলেজের চাকুরি, আইনজীবী হিসেবে সর্বোচ্চ আদালত হতে নিম্ন আদালতে নিযুক্ত হয়ে দেশ সেবক হিসেবে তারা নিয়োজিত হচ্ছেন। সুনামের সাথে কাজ করছেন। আইন পেশায় আইনজীবী ও আদালতগুলো বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় করে দিচ্ছেন সরকারকে। তাদের অধীনে আছে হাজার হাজার আইজীবী সহকারী। বেকার সমস্যার সমাধানে তারা রাখছেন অসামান্য অবদান।
আইন-আদালতে দেওয়ানী বিরোধ একটি চিরন্তন বিষয় হিসেবে গণ্য। এরই সাথে আছে ফৌজদারী অপরাধ। উভয় ধরণের বিরোধ ও অপরাধ এর প্রতিকার, প্রতিবিধান ও দমনের হাতিয়ার আদালত ও আইনজীবী।

আইন পেশায় আসার পথে একজন আইনের ছাত্রকে একটি কঠিন সময় পার করতে হয়। সরকারি চাকুরি হলে তো হলোই- না হলে একজন আইনজীবীর অধীনে তাকে কমপক্ষে ৬ মাস শিক্ষানবীশ কাল অতিক্রম করতে হয় অনেকটা কঠোর সাধনার মধ্য দিয়ে। এই সময় তার না আছে আর্থিক নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা, না আছে আইন পেশায় আসার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি। এরপর অনিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত বার কাউন্সিলের সনদের জন্য ৩টি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়।

সেখানেও তীব্র প্রতিযোগিতা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলেই কেবল কেউ একবারেই উত্তীর্ণ হয়ে সনদ নিয়ে আইনজীবী সমিতিতে যোগ দিয়ে আইন পেশায় যুক্ত হন। এবার আইন পেশায় এসেও তাকে পড়তে হয় তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে। প্রতিদিন তার জীবনের চ্যালেঞ্জ শুরু হয় কালো গাউন গায়ে চড়িয়ে। আদালত প্রাঙ্গনের একটি চালা ঘরেই হয়তো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আইনী সহায়তা দিতে তাকে নিয়মিত বসতে হয়। ভাগ্য ভাল হলে সুন্দর একটি কক্ষ আইনজীবী সমিতিগুলোর বদান্যতায় বন্দোবস্ত থাকলে তো ভালই।

দেশের মেধাবী তরুণদের এমনটাই পেশার সংকট মোকাবেলা করতে হয়। এখানে সরকারি উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা খুব চোখে লাগে। তারপরও আইন পেশার সম্মান, পেশাদারিত্ব ও গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে। যতদিন রাষ্ট্র ও আইনের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন তরুণরা এই চ্যালেঞ্জিং পেশাকে বুক পেতে গ্রহণ করবে এমন একটা ঝোঁক লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে দেশের আইন শিক্ষায় বিশেষ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা যাচ্ছে। সেটার প্রথম পদক্ষেপ হলো- শিক্ষার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে আইন শিক্ষার প্রবর্তন করা। এখানে ‘আইনবিজ্ঞান’ নামে একটি বিষয় চালু করা দরকার। সিলেবাস নিয়ে কাজ করা দরকার। মাধ্যমিক স্তরে বিষয়টির ১ম পত্র হবে তাত্ত্বিক আর ২য় পত্র হবে বাংলাদেশের আইন, সংবিধান ও আদালত কাঠামো।

উচ্চ মাধ্যমিকেও এমনটা হতে পারে। আইন পাঠে স্নাতক স্তরে আইনবিজ্ঞান নামে যে কোর্সটি পড়ানো হয় সেটাকেই উপযোগী করে সিলেবাস তৈরি হতে পারে।

এই বিষয়টি পাঠকারী শিক্ষার্থীরা আইন বিষয় নিয়ে উচ্চতর পড়াশুনায় আরও আগ্রহী হবে এবং বুনিয়াদ পাবে। আইনের উচ্চতর অধ্যয়নে না গেলেও আইনের প্রতি প্রতিটি শিক্ষার্থীর একটি মনোজগত সৃষ্টি হবে। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি হবে। নাগরিক জীবনে সুশাসন ও আইনের শাসনের ভিত্তি মজবুত হবে। একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের কাঠামো ধীরে ধীরে বিকশিত হবে।

আর্থিকভাবে দূর্বল ও মেধায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা আইন পাঠের সাথে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পরিচিত থাকলে- এরা সমাজের নেতা হলেও সমাজের ও দেশের উপকার হবে বিপুল। এরা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে আইনগত দৃষ্টিভঙ্গীতে কাজ ও সেবা দিতে পারবে। হোক না সে- ইউনিয়নের মেম্বার, পৌরসভার কাউন্সিরর বা চেয়ারম্যান, মেয়র। এরা সালিস- দরবার, পাারিবারিক আদালত এবং গ্রাম আদালতে অবদান রাখকে সক্ষম হবে। কিছু ঝরে পড়া যুবকরা বেকারের জীবন বেছে না নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই আইনজীবীর সহকারীর দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবেন। মানব সম্পদ উন্নয়নের নতুন দিগন্ত খুলে দিবে। দেশের সকল চিন্তাশীল মানুষদেরকে বিষয়টি ভেবে দেখার প্রস্তাব করছি। 

লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, কুমুদিনী সরকারি মহিলা কলেজ, টাঙ্গাইল


সর্বশেষ সংবাদ