সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে বিক্ষোভ কেন?
- মো. হাসান তারেক
- প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০১৯, ০২:২৫ PM , আপডেট: ০৯ আগস্ট ২০১৯, ০২:২৫ PM
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কাশ্মীর ৫ই আগস্ট, সোমবার বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর থেকে বিক্ষোভের নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছে। ভারত সরকারের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারছেন না কাশ্মীরের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ আপামর জনগণ। ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে তারা “পোড়া মাটির নীতির” সঙ্গে তুলনা করছেন। সাধারণ জনগণ বলছেন, “জনগণ নয়, কাশ্মীরের জমিন চায় ভারত”।
সরকার কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য চালিয়ে যাচ্ছে ব্যাপক গ্রেপ্তারসহ ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানোর কাজ। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কাশ্মীরি রাজনীতিকসহ ৫৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ব্যবসায়ী নেতা এবং অধিকারকর্মীরাও রয়েছেন। পাশাপাশি, কারফিউ অব্যাহত থাকায় ৮০ লাখ মানুষ পড়েছে বন্দিদশায়। তবে, অবস্থার নিরীক্ষে বলা যায় যে, সরকারের এই বিক্ষোভ নিরসনের পন্থা সফলকাম না হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আসন্ন।
কাশ্মীর সংকটের উৎসের সন্ধান করলে দেখা যায় যে, সামনে সংকট কত প্রকট হতে পারে। অবিভক্ত ভারতের সর্ববৃহৎ দেশীয় রাজ্য ছিল কাশ্মীর। কাশ্মীরের তিনটি প্রদেশে মুসলমানদের সংখ্যানুপাত ছিল : কাশ্মীর প্রদেশে ৯৩%, জম্মু প্রদেশে ৬১% এবং গিলগিটে ৯৯.৫%। ব্রিটিশ শাসনাধীনে ১৮৪৬ সালের ১৬ মার্চ অমৃতসর চুক্তি মোতাবেক তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার রাজ্যটি ৭৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে গলাব সিংহ নামে জনৈক দেশীয় ডোগরা গোষ্ঠী সর্দারের কাছে বিক্রি করে দেয়। ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন ব্রিটেনের পার্লামেন্ট যখন ব্রিটিশ শাসনের অবসান করে ভারতকে স্বাধীনতা প্রদান এবং একে দ্বিখন্ডিত করে পাকিস্তান সৃষ্টির ঘোষণা প্রদান করে তখন ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলো সর্ম্পকেও সুনিদিষ্ট ঘোষণা প্রদান করা হয়েছিল। দেশীয় রাজ্যগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের ইচ্ছানুযায়ী ভারত বা পাকিস্তানের সাথে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল।
এ ব্যবস্থা অনুযায়ী অধিকাংশ রাজ্য ভারতের সাথে এবং কিছু কিছু পাকিস্তানের সাথে অঙ্গীভূত হয়। কিন্তু, কাশ্মীরের রাজা হরিসিংহ স্বাধীন থাকার মনোভাব গ্রহণ করলেও ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের উপজাতীয় মুসলমানদের মুজাহিদ বাহিনী মহারাজার সৈন্যদলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলে মহারাজা পালিয়ে দিল্লী পৌঁছেন। ভারতের শেষ ভাইসরয় এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের সঙ্গে ২৬ শে অক্টোবর কাশ্মীরকে ভারতভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই সিদ্ধান্তের পর থেকে সূত্রপাত ঘটে অস্থিরতার ও ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের। ১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মত ভয়াবহ ধ্বংসলীলায় অবর্তীণ হয় কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্ত্র করে।
পরবর্তীতে, ১৯৯৯ সালে জম্মুৃ ও কাশ্মীরের কারগিল ও দ্রাস সেক্টরকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এযুদ্ধটি স্থানীয় ভিত্তিক একধরনের ছায়াযুদ্ধ হলেও এর ক্ষয়-ক্ষতি ছিল অনেক। এভাবে, রাজা হরিসিংহের একটি জনবিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত কাশ্মীর সংকটকে প্রকট থেকে প্রকটতর করে। এখন কাশ্মীরের সাধারণ জনগণ আন্দোলন করে যাচ্ছে দুইটি উদ্দেশ্যকে কেন্ত্র করে। প্রথমত, ভারতীয় শাসন থেকে মুক্ত হওয়া এবং দ্বিতীয়ত, জম্মু ও কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার জন্য গণভোটসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য।
কিন্তু, এবারও নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার যে কাশ্মীরি জনগণের মনের কথা বুঝতে ভুল করল তার বড় নমুনা বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পরবর্তীতে জন আন্দোলন। সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদ বাতিলের ফলে, জম্মু-কাশ্মীর দ্বিখন্ডিত হয়ে মর্যাদা হারাল পৃথক রাজ্যের। একই সঙ্গে এই রাজ্যকে ভাগ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়া হয়। একটি জম্মু ও কাশ্মীর এবং অন্যটি লাদাখ। কাশ্মীর হলো মুসলিম-অধ্যুষিত। জম্মু-হিন্দু অধ্যুষিত আর লাদাখ বৌদ্ধ-অধ্যুষিত। জম্মুও কাশ্মীর এখন নিয়ন্ত্রণ করবে কেন্দ্রীয় সরকার। এখন, কাশ্মীরের আর পৃথক সংবিধানও থাকবে না।
আলাদা আইনকানুন দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হচ্ছিল এতদিন। এ কারনেই অন্য রাজ্যের অধিবাসীরা সেখানে জমি কিংবা সম্পদ কিনতে পারতেন না। কিন্তু, এখন অন্য রাজ্যের জনগণ ও সম্পদ ক্রয় করতে পারবে। ফলে, কমে যেতে পারে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্টতা।
সরকারি দপ্তরের চাকুরিগুলোতে সকলের প্রবেশাধিকার উম্মুক্ত হল।
কাশ্মীরের জনগণকে শান্ত ও আশ্বস্ত করার জন্য নরেন্দ্র মোদী ৮ই আগস্ট যে কথাগুলো বললেন সেগুলোকে কাশ্মীরের জনগণ ইতিবাচক ভাবে নিচ্ছেন না। বরং বিশ্ব গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই পদক্ষেপের সমালোচনায় মুখর। বাস্তবতার নিরীক্ষে তাদের এই সমালোচনা যৌক্তিক। কেননা, নরেন্দ্র মোদীর সরকারের এই উদ্যোগ ভারত বিভক্তি ও উগ্রবাদকে উৎসাহিত করবে।
কাশ্মীর যেমন উত্তপ্ত হবে তেমনিভাবে উৎসাহিত হবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী গ্রুপগুলো। কাশ্মীর ইস্যু তাৎক্ষনিকভাবে উসকে দিয়েছে পৃথক গোর্খাল্যান্ড ও নাগাল্যান্ড রাজ্যের দাবিকে। মিজোরামের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী লাল থানওয়ালা জম্মু ও কাশ্মীরের ঘটনাকে উত্তর-পূর্বরাজ্যগুলোর জন্য “রেড অ্যালাট” বলে উল্লেখ করেছেন। জম্মু ও কাশ্মীর দ্বিখন্ডিত হওয়ার বিষয়টি দার্জিলিংয়েও পৃথক রাজ্যের দাবিকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। দার্জিলিংয়ের পৃথক রাজ্য গড়ার নেতা গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিমল গুরু আত্নগোপনস্থল থেকে একবার্তায় দার্জিলিংয়েও কেন্ত্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছেন।
অতএব, সামনের দিনগুলোতে ঐক্যবদ্ধ ভারত নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল। পাশাপাশি, ভারতকে কেন্দ্র করে অস্থির হতে পারে দক্ষিণ-এশিয়ার দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা। কেননা, ভারতের এই নাজুক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে উগ্রবাদী গ্রুপগুলো এবং ভারত বিরোধীশক্তিগুলো। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই কাশ্মীর জুয়া হয়ে যেতে পারে তার বিরোধী পক্ষ কংগ্রেসে ও তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য রাজনীতির নতুন ইস্যু ও জনসমর্থন আদায়ের নতুন অস্ত্র।
লেখক:- মোঃ হাসান তারেক
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ডক্টর মালিকা কলেজ, ঢাকা।