প্রশ্নফাঁস ব্যাধি থেকে আরোগ্য মিলবে কবে?

  © প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি চাকরির পরীক্ষা ও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন যা আমাদের ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিসিএস, খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা, অডিট, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, এনবিআর, এটিইও, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, সমাজসেবা কর্মকর্তা, মেডিকেল, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, এসএসসি, এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ও অভিযোগ পাওয়া যায়।

বিভিন্ন সূত্র মতে, বর্তমান সরকারের সময়ের মতো অতীতে এত বেশি ও গণহারে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা কখনো ঘটেনি। ২০১৫ সালের টিআইবির এক রিপোর্টে  বলা হয়েছিল, বিগত চার বছরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মোট ৬৩টি ঘটনা ঘটেছে। 

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রশ্ন ফাঁসকারী একাধিক চক্র এর সঙ্গে জড়িত। তারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে থাকে। প্রযুক্তির অপব্যবহার করেও এরা পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করছে। এদের নেপথ্যে শক্তিশালী হাত থাকার আভাস পাওয়া যায়। অভিযোগ করা হয়ে থাকে সর্ষের ভেতরেই রয়েছে ভূত। নাহলে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের কেন ধরা হচ্ছে না। গুগল থেকে নেওয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে একটি কৌতুক বলি। যেখানে হাসির মধ্যেও ফুটে উঠেছে প্রশ্ন ফাঁস তৎপরবর্তী নির্মম চিত্র।

স্যার : বল তো প্রশ্নফাঁস আর গলায় ফাঁসের মধ্যে পার্থক্য কী?

ছাত্র : গলায় ফাঁস হলে একজনের মৃত্যু হয়; আর প্রশ্নফাঁস হলে পুরো জাতির মৃত্যু হয়।

হ্যাঁ তাইতো। প্রশ্নফাঁস করে শুধু একজন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। এর মধ্য দিয়ে জাতির ঘটছে নৈতিক অবক্ষয় তথা মৃত্যু। শিক্ষক,অভিভাবক, কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী- আজ প্রশ্ন ফাঁসে জড়িয়ে পড়েছেন। এটা কি কল্পনা করা যায়! প্রশ্নফাঁসের কারণে দেখা দিচ্ছে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা। আবার কেউ কেউ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে নানা রকম গুজব ছড়াচ্ছেন। এতে কান দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অভিভাবকরাও। এ নিয়ে যারপর নাই অভিভাবকরা হতাশ ও চিন্তিত। এ অবস্থায় যেকোনো মূল্যে প্রশ্ন ফাঁস রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধানসহ আইন রয়েছে। কিন্তু সেই আইনে কারো সাজা হয়েছে এমন নজির মেলে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯১ বছরের ইতিহাসে প্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে আজ থেকে নয় বছর আগে ২০১০ সালের ২১ জানুয়ারি। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষে অনার্স প্রথম বর্ষ ভর্তি পরীক্ষার তিনটি সেটের সব প্রশ্ন ফাঁস হয়। এ ঘটনায় ওই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল।

প্রশ্নফাঁস রোধে ঢাবি কিছুটা নজির দেখাতে সক্ষম হয়েছে। গত বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৫ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।। এটি একটি উত্তম দৃষ্টান্ত এসময়ের প্রেক্ষিতে। আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে নিজেদের যুক্ত করছি। দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি উন্নত দেশের মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষায়। সরকার ইতোমধ্যে কিছু বড় বড় উন্নয়ন কাঠামো উপহার দিয়ে জনগণকে কিছুটা হলেও শান্তনা দিতে পেরেছে। 

যদি জাতি পায় আগামী দিনে অদক্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত জনবল ও প্রশাসন? আজ রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে জালিয়াত চক্র ও অসাধু ও দুর্নীতিগ্রস্ত কিছু কর্মকর্তা, যারা জাতি বিনাশী কিছু কার্যকলাপে লিপ্ত। যাদের অশুভ কর্মতৎপরতার কারণে সরকারের গৃহীত জনবান্ধব উন্নয়ন অগ্রগতি ম্লান হওয়ার উপক্রম। সাম্প্রতিক সময়ে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বালিশসহ অন্যান্য আসবাবপত্রের ক্রয় ও উত্তোলনের ব্যয় নির্বাহ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির খবর ভাইরাল হয়। এছাড়া  সাতক্ষীরায় মাটির নিচে কয়েক বস্তা সরকারি ওষুধের খনি আবিষ্কারের খবরে জনগণ যারপরনাই শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ।

এগুলো হচ্ছে বর্তমানে আমাদের চারিত্রিক অবক্ষয়ের চাক্ষুষ রগরগে কিছু প্রমাণ। এসব বাদেও দৃষ্টিসীমার অগোচরে কতিপয় অসৎ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কতভাবে যে জনগণের ক্ষতি করছেন! তারা জনগণের অর্থ ইচ্ছেমতো উড়িয়ে দিচ্ছেন। আত্মসাত করছেন! তা স্রষ্টা মাত্রই মালুম। সাধারণ জনগণের এসব নিয়ে তেমন একটা মাথা ব্যথা নেই।এদেশের জনগণ ধীরে ধীরে হচ্ছেন আত্মকেন্দ্রীক ও নিজস্ব চিন্তার জগতে নিবিষ্ট। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ভাবনা তাদের হৃদয় বন্দরে ঢেউ তোলে না। যার বড় প্রমাণ সারাদেশব্যাপী ধানের বিক্রয় মূল্য নিয়ে কৃষকদের ও সাধারণ জনগণের জোরালো আন্দোলনের ব্যর্থতা। অথচ এ কৃষকরাই ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠীর জন্য ছিল মহা আতঙ্ক। যেন সাক্ষাৎ যমদূত।

বর্তমান সরকারের সময় চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা, মেডিকেল পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা, বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা,  সরকারী বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রশ্নফাঁস মহামরি আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস যার জ্বলজ্বলে প্রমাণ। জাতি বিনাশী এ চক্রের রাঘব বোয়ালদের মূলোপাটন তৎপরতা অতীব জরুরী। অদৃশ্য ইশারায় পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস বন্ধে অবহেলা ও গৌণভাবে দেখা নিঃসন্দেহে চরম গর্হিত কাজ।

বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আজ এ ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না। গত ২৪ মে সাতক্ষীরা থেকে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ২৯ জনকে আটক করেছে র‌্যাব-৬। এদিকে গতকাল দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পটুয়াখালীতে ৩৩ জনকে আটক করেছে পুলিশ। দিনদিন প্রশ্নপত্র ফাঁসের লাগাম যেন টেনে ধরাই যাচ্ছে না। এ মহামারী  থেকে উদ্ধার করে জাতিকে পরিত্রাণেরও কোনো দূত আপাতত আবির্ভাবহীন।

এতকিছুর পরেও সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে জ্বলছে আশার মিটমিট আলো।২০১৭ সালে দেশব্যাপী আলোচিত হয় ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ শিক্ষার্থীসহ মোট ১২৫ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। রাজধানীর মালিবাগে প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন সিআইডি প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জড়িতদের মধ্যে অন্তত ২১ জন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মী। ছাত্রলীগের জড়িত ২১ জনের মধ্যে ১৮ জন বিভিন্ন কমিটির পদধারী নেতা ছিলেন। আর তিনজন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। এখানে ভাবনার বিষয় ছাত্রলীগ হলো সরকার দলের ছাত্র সংগঠন। যে সংগঠনটি সরকারের সহায়ক হিসেবে ছাত্রদের অধিকারে সোচ্চার হওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে মারামারি, চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যার সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং ছাত্রলীগের কারণে সরকারের ভালো উন্নয়ন ও সফলতা অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে।

রাজনৈতিক পরিচয়কে পাশ কাটিয়ে গত কয়েক বছরের প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন ছাড়া সমাজে আইন প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। যত ব্যবস্থার কথাই বলা হোক না কেন, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে কোনো অবস্থায়ই এদের থামানো যাবে না। মোটাদাগের কথা হলো বড় সর্ষের ভেতরের ভূত আগে তাড়াতে হবে। ভেতরের কোনো সহযোগিতা ছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁস অসম্ভব ব্যাপার। এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশ্নফাঁস রোধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জাতি মুক্তি পাক জাতির মেধা বিনাশী প্রশ্নপত্র ফাঁসের এ মহামারি ও মহোৎসব থেকে।

প্রশ্নফাঁস রোধে টিআইবির ৯ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র পাওয়া যেন জলবৎ তরলং। ছেলের হাতের মোওয়া। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া আরেকটি কৌতুক দিয়ে শেষ করি।

বন্ধু-১ : নতুন বছরে তোমার প্ল্যান কী?

বন্ধু-২ : সেবার মাত্র একদিন আগে প্রশ্ন পেয়েছিলাম। এবার যেন আগে থেকেই প্রশ্ন পেতে পারি, সে চেষ্টা করব।

আমাদেরও যারা উপর মহলে আছেন তাদের চেষ্টা থাকবে এ ধরনের প্ল্যান আগে ভাগেই কীভাবে নসাৎ করে দেওয়া যায়, যাতে জাতি বিধ্বংসী প্রশ্নফাঁসের যাঁতাকলে জাতিকে যেন পিষ্ট হতে না হয়। পরিশুদ্ধ হোক সব আত্মা। সৎ ইচ্ছা ও কর্মযজ্ঞের হোক শুভ সূচনা। আরোগ্য লাভে ধন্য হোক জতির মনন ও মেধা। প্রশ্নফাঁসের ব্যাধি থেকে ঘটুক চির মুক্তি।

লেখক: শিক্ষক, গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ