রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন, জনদুর্ভোগের প্রশ্নে বিবেচনা জরুরি

সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন
সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন  © সংগৃহীত

বর্তমান বাংলাদেশে মত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে রাজপথ। যে কোনো দাবি-দাওয়া, অসন্তোষ কিংবা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে রাস্তায় নামা যেন এখন একমাত্র ভরসা। বিশেষ করে শিক্ষার্থী, শ্রমিক, রাজনৈতিক সংগঠন কিংবা পেশাজীবী শ্রেণির অনেকেই তাদের অবস্থান জানান দিতে রাজপথকেই বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই প্রতিবাদ পদ্ধতি কতটা যুক্তিসংগত? রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করা কি আদৌ নাগরিক অধিকার প্রয়োগের একটি গ্রহণযোগ্য উপায়, নাকি এটি বৃহত্তর জনদুর্ভোগের বৈধতা?

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। এসব দাবি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণের যোগ্য। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, এসব দাবির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষার্থী এবং রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে দিনের পর দিন সড়ক অবরোধ করছেন, তাতে জনজীবনে চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এই পরিস্থিতি সমাজে এক ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে, যা ন্যায্য আন্দোলনের উদ্দেশ্যকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে পারে।

সড়ক অবরোধ একটি পুরোনো এবং বহুল ব্যবহৃত আন্দোলনের কৌশল। আমাদের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে রাস্তা দখল করে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার নজির রয়েছে। কিন্তু সেসব আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, সময় ও পদ্ধতির সঙ্গে বর্তমানের আন্দোলনের তুলনা ভেবে দেখা উচিত। এখনকার দিনে রাজধানীসহ প্রধান শহরগুলোতে জনসংখ্যা ও যানবাহনের ঘনত্ব এতটাই বেড়েছে যে, একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ঘণ্টাখানেক রাস্তায় অবস্থান করলেই পুরো শহরের সঞ্চালন থমকে যায়। কর্মজীবী মানুষ, রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, পরীক্ষার্থীরা এমনকি স্কুলগামী ছোট ছোট শিশুরাও অসহনীয় ভোগান্তির শিকার হন।

রাস্তায় নামার পেছনে একটি বড় কারণ হলো- দাবি আদায়ের অন্য কোনো কার্যকর মাধ্যম না থাকা। দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগের পরও যখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয় না, তখন অনেকেই মনে করেন রাজপথেই জবাব দিতে হবে। বাস্তবতা বলছে, অতীতে অনেক সময় রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করেই দাবি আদায় সম্ভব হয়েছে। ফলে এই পদ্ধতিকে অকার্যকর বলা যায় না। তবে সেই সঙ্গে অস্বীকার করা যায় না, এই ধরনের আন্দোলনের সরাসরি ভুক্তভোগী হন সাধারণ মানুষ। যেসব রাস্তায় আন্দোলন হয়, সেসব এলাকার জনগণের জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া মানুষ আটকে পড়েন দীর্ঘ যানজটে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে প্রাণ হারান রোগী, চাকরির ইন্টারভিউ বা পরীক্ষায় পৌঁছাতে পারেন না অনেকে। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব শ্রেণির মানুষ পড়ে যান অনিশ্চয়তার মুখে। একটি শ্রেণি যখন তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামে, তখন আরেক শ্রেণির স্বাভাবিক জীবনযাপন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় এটি একটি উদ্বেগজনক অসাম্য।

আরও পড়ুন: রাজধানীর যেসব সড়কে আজও চলবে আন্দোলন

আমরা দেখতে পাচ্ছি, শিক্ষার্থীদের সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ ছিল যথেষ্ট যৌক্তিক ও জরুরি। কিন্তু একইসঙ্গে লক্ষ্য করার বিষয়, যখনই আন্দোলনের কারণে রাস্তায় গিয়ে জনজীবন অবরুদ্ধ করে, তখনই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। অনেকে এই আন্দোলনকে ‘উচ্ছৃঙ্খলতা’ বা ‘চাপে ফেলা কৌশল’ হিসেবে দেখতে শুরু করেন। এমনটি হলে আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার মৌলিক। কিন্তু এ স্বাধীনতা তখনই কার্যকর ও সম্মানজনক, যখন তা অন্য কারও অধিকারের ক্ষতি না করে প্রয়োগ করা হয়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন আটকে রাখা মানে হাজারো মানুষকে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। যেমন- সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছানো, চিকিৎসা গ্রহণ করা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া। একে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক চর্চার আদর্শ রূপ বলা যায় না।

আমাদের আচরণে একটি উচ্চতর নৈতিক মানদণ্ড থাকা উচিত। আমরা যদি এমন কোনও পথ বেছে নেই যা জনভোগান্তি তৈরি করে, তাহলে তা সমাজে নেতিবাচক বার্তা দেয়। এ অবস্থায় আন্দোলনের পদ্ধতি ও পরিসর সম্পর্কে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। সবার উচিত আন্দোলনের বিকল্প ও সৃজনশীল উপায় খুঁজে বের করা।

অন্যদিকে, রাষ্ট্র ও প্রশাসনের দিক থেকেও এসব দায় এড়ানো সম্ভব না। যদি কোনো যৌক্তিক দাবি দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষা করা হয়, তবে তা যেকোনো সময় আন্দোলনে রূপ নিতে পারে। রাস্তায় নামার আগেই যদি প্রশাসন সক্রিয় হয়ে সমস্যার সমাধান করত, তাহলে এই অচলাবস্থা তৈরি হতো না। অতীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে প্রশাসনের অবহেলা বা গড়িমসি শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে এবং তারা বাধ্য হয়েছে কঠোর কর্মসূচি নিতে। প্রশাসনের উচিত সবার দাবির প্রতি দ্রুত, সংবেদনশীল ও কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখানো। সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণমূলক ও সমঝোতামূলক পন্থা গ্রহণই হতে পারে টেকসই সমাধানের পথ। আন্দোলনের ন্যায্যতা থাকলেও, পদ্ধতির মধ্যে সংযম থাকা জরুরি। রাষ্ট্রকে যেমন জনগণের কণ্ঠস্বর শোনার দায়িত্ব নিতে হবে, আন্দোলনকারীদেরও সচেতন থাকতে হবে। আমাদের প্রতিবাদ যেন আরেকজনের দুর্ভোগে পরিণত না হয়। অন্যথায় আন্দোলনের প্রতি মানুষের সহানুভূতি কমে যাবে, এবং তা হবে গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য এক অশনিসংকেত।

শেষ কথা হলো, আমাদের দাবি আদায়ের সংগ্রাম ন্যায়সংগত হলেও তার প্রয়োগে থাকতে হবে সংযম ও দায়িত্ববোধ। আমাদের প্রয়োজন একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি; যেখানে প্রতিবাদ থাকবে, থাকবে সংলাপ, যা হবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কেন্দ্র করে, তাদের সঙ্গে মিলেমিশে। আন্দোলন হোক গণতন্ত্র ও ন্যায়ের পথে, আর রাষ্ট্র হোক সহনশীল ও দায়িত্বশীল—এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।


সর্বশেষ সংবাদ