স্বল্প শিক্ষকের পাহাড়সম দায়িত্বে চলছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

৮৮০টি কলেজে শুধু অনার্স-মাস্টার্স পড়ানো হয় না। ৮৮০টি কলেজে শুধু অনার্স-মাস্টার্স থাকা মানে দেশে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি এই ৮৮০টিও ইফেক্টিভলি বিশ্ববিদ্যালয়। এদিক থেকে আমরা কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কে উপজেলা লেভেলেও নিয়ে গিয়েছি। দেশ ভরে ফেলেছি অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী দিয়ে।

এই ৮৮০টি কলেজে একই সাথে সেখানে থাকে এইচএসসি, বিএ/বিএসসি পাস ডিগ্রিও পড়ানো হয়। অধিকাংশ কলেজের একেকটি বিভাগে ২ থেকে খুব বেশি হলে ৮ জন শিক্ষক থাকে। এই শিক্ষকদের প্রায় সবারই সবচেয়ে বড় ডিগ্রি হলো মাস্টার্স এবং ক্ষেত্র বিশেষে এমফিল। আর কদাচিৎ কিছু কিছু কলেজে এক বা দুই জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষক আছেন।

যেখানে অনার্স-মাস্টার্স থাকবে সেই প্রতিষ্ঠানকে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ই বলা যায়। অথচ অতি স্বল্পসংখ্যক শিক্ষক যা আছে তাদেরকে অনার্স পড়ানোর যথেষ্ট যোগ্য হিসাবে ধরে নিলেও মাস্টার্স পড়ানোর জন্য একেবারেই নয়। তার উপর তাদের উপর এইচএসসি পড়ানোর দায়িত্ব, বিএ বা বিএসসি পাস পড়ানোর দায়িত্ব আছে। এই শিক্ষকরা চাইলেও পারবেন না। অনার্স বা মাস্টার্সের একটি কোর্স পড়াতে হলে অনেক প্রস্তুতি লাগে।

অর্থাৎ স্বল্প সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে পাহাড় সমান দায়িত্ব দিয়ে চলছে আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের কলেজগুলো। ফলে অধিকাংশ কলেজেই ক্লাস প্রায় হয় না বললেই চলে। আমি আমার বাজিতপুর কলেজের খোঁজ নিয়ে দেখেছি। বিএ/বিএসসি পাস এবং অনার্সের ক্লাস হয় না বললেই চলে। এইচএসসির ক্লাস হয়। কিন্তু সেটাও আমাদের সময়ে যেভাবে এবং যত সিরিয়াসলি পড়ানো হতো তা এখন আর হয় না।

আমাদের সময়ের শিক্ষকরা একটা আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। আমার বাজিতপুর কলেজের ইংরেজির শিক্ষক ফজলে এলাহী স্যার, বাংলার শিক্ষক আহাদ স্যার, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক সন্তোষ স্যার, জীববিজ্ঞানের শিক্ষক পরিতোষ স্যার, রসায়ন পড়াতেন মাখন স্যার এবং গণিতের শিক্ষক নুরুজ্জামান স্যার খুবই ভালো মানের শিক্ষক এবং একই সাথে ভালো মানুষ ছিলেন।

তারা কেউ রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না। পড়াতেন, নিজে পড়তেন এবং নিজেরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিয়ে দিন পার করতেন। তাদের চালচলন, বেশভূষা ও হাঁটাচলাতেও  ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল স্পষ্ট। একইসাথে মেরুদন্ডও ছিল শক্ত, যা এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাঝেও দেখি না। একটা প্যারাডাইম শিফট হয়ে গেছে।

লকডাউন শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেঅধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন

তাহলে কি দাঁড়ালো? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এই ৮৮০টি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানোর অনুমতি দিয়ে আমরা জাতীয় অন্যায় করে চলেছি। শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত করছি। তাদের ক্লাস হয় না বললেই চলে। কিন্তু পরীক্ষা হয়, পাস করে এবং সার্টিফিকেট পায়।

আমরা আসলে জিপিএ-৫ এর বন্যা বইয়ে দিয়ে এসএসসি-এইচএসসি রেজাল্টকেও সার্টিফিকেট সর্বস্ব করে ফেলেছি। অসংখ্য ছেলে-মেয়ে জিপিএ-৫ পাচ্ছে। ফলে অনার্স-মাস্টার্স পড়ার চাপও তৈরি হচ্ছে। সেটাকে মিটিগেট করার জন্যই এই অন্যায় আমাদের সরকার বছরের পর বছর করে আসছে। আমরা জনগণও এইটা মেনে নিয়েছি।

অথচ এই ছেলেমেয়েদের অনার্স-মাস্টার্স না পড়িয়ে এদেরকে যদি কারিগরি শিক্ষায় ধাবিত করতে পারতাম তাহলে দেশের বেকার সমস্যার সমাধান হতো। সারা পৃথিবীতে তাই করা হয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এতগুলো কলেজকে অনার্স-মাস্টার্স পড়ানোর অনুমতি দিয়ে আমরা কলেজগুলোতে এইচএসসি পড়ানোর গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছি। এটা বিশাল ক্ষতি। এই ক্ষতি নিয়ে কেউ আলাপ করে না।

আমি অনেক ছেলেমেয়েকে দেখেছি, যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছে বা অন্য সাবজেক্টে অনার্স-মাস্টার্স করেছে, কিন্তু জ্ঞান শূন্য।

আমি একটি হলের আবাসিক শিক্ষক থাকার সময় কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডে ছিলাম। সেখানে অত্যন্ত কম বেতনের ছোট চাকরির জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্সে ভালো রেজাল্টওয়ালাও দরখাস্ত করতে দেখেছি। কিন্তু ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় মনে হয়েছে, এদেরতো একজন উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্রের জ্ঞানও নাই। কিন্তু এটাও বলতে হবে সবাই যে খারাপ তা না। কেউ কেউ নিজের চেষ্টায় এবং কোচিং-এর সহযোগিতায় লেখাপড়া করেছেন এবং তারা খুবই মেধাবী। এমন মেধাবী শিক্ষার্থীও আমি দেখেছি।

আমরা যদি ভালো মানের শিক্ষক এবং যথেষ্ট সংখ্যক শিক্ষক এই কলেজগুলোকে দিতে পারতাম, তাহলে এদের মধ্যে অনেকেই অসাধারণ ভালো করতে পারতো। সরকার শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে পারতো। একই সাথে কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে পারতো। সেখানে ভালো বেতন দিয়ে বিশ্বমানের কারিগরি কলেজ বানালে দেশ গঠনে ভালো কাজ হতো।

আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের স্কুলে বিএসসি স্যার ছিলেন। অসাধারণ। আগের দুই বছরের বিএ ও বিএসসি কোর্স কিন্তু খুবই ভালো ছিল। এখন সেটাকে ৩ বছরের করা হয়েছে। কিন্তু এটার গুরুত্ব আর আগের মত নাই। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের ন্যূনতম যোগ্যতা করা উচিত বিএ /বিএসসি এবং এর গুরুত্ব বাড়ানো উচিত।

আমাদের সরকার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় মিলে আমাদের সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে ধ্বংস করে ফেলেছে। শুধু এই সরকার না। এর আগের সরকারগুলোও একই। এমন একটি ক্ষেত্র পাবেন না যেখানে তারা শিক্ষার মানের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। গত ৫২ বছরে একটা ভালো মানের স্কুল তৈরি করতে পারেনি। উল্টো যেগুলো ভালো ছিল সেগুলোকে নষ্ট করেছে। 

আমাদের প্রাথমিক স্কুলগুলো কেমন? সেইসব স্কুলের শিক্ষকদের বেতন কেমন এবং তাদের মান কেমন? আমাদের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলো কেমন? সেসব স্কুলের শিক্ষকদের বেতন কেমন এবং তাদের মান কেমন? সমাজে এই শিক্ষকদের অবস্থান কি?

শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষকদের বেতন ও সম্মান বাড়িয়ে এই বিষয়ে কাজ করলে দেশের শিক্ষার মান বাড়ানো সম্ভব। কারিকুলাম বদলানোর আগে এই কাজগুলো করে প্রমাণ করুন আপনারা শিক্ষার মান বাড়াতে চান। ফিনল্যান্ড পদ্ধতি আনতে হবে কেন? পাশের দেশ ভারতের দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের মডেল আনুন না। উনি দেখিয়েছেন স্কুল শিক্ষকের মান এবং স্কুলের অবকাঠামো উন্নত করেই শিক্ষার মানের অনেক উন্নতি সম্ভব।

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence