৫০ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর চিঠি সংরক্ষণ করা মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী করছেন ভিক্ষা

শহীদ রমযান আলীর স্ত্রী ইফাতন বেওয়া
শহীদ রমযান আলীর স্ত্রী ইফাতন বেওয়া  © সংগৃহীত

৫০ বছর ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিঠি সংরক্ষণ করে রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ রমযান আলীর স্ত্রী ইফাতন বেওয়া। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও অকাল বিধবা এই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর দুঃখ-কষ্ট লাঘব হয়নি। বর্তমানে তিনি চরম অর্থাভাবে ভিখারির কাজ করছেন।

ইফাতন বেওয়ার বাড়ি টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বলিভদ্র ইউনিয়নের পানকাতায়। একাত্তরে পানকাতা গ্রাম প্রশাসনিকভাবে গোপালপুর উপজেলাধীন ছিল। এখন সেটি ধনবাড়ী উপজেলার অন্তর্গত।

মুক্তিযুদ্ধে পানকাতা হাই স্কুল ছিল কাদেরীয়া বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। একাত্তরের ৩০ সেপ্টেম্বর গোপালপুর থেকে পাকিস্তানি হানাদাররা পানকাতা ক্যাম্প দখলে এগিয়ে আসে। মাহমুদপুর বটতলায় মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গাল বাধা দেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বর্বররা শুরু করে গণহত্যা। ওই যুদ্ধে শহীদ হন তার স্বামী।

১৯৭২ সালের ২০ ডিসেম্বর তারিখ উল্লেখ করা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাক্ষরিত ওই ‍চিঠির বর্ণনায় ইফাতনকে বোন সম্বোধন করে বলা আছে, “প্রিয় বোন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইলো আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার পরিবারের সাহাযার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহকুমা প্রশাসকের নিকট ২ হাজার টাকার চেক প্রেরিত হলো। আমার ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।”

তার নিকট এটি শুধু কাগুজে চিঠিই নয়, বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে নিহত স্বামীর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। অনটনের সংসারে অনেক কিছু হারালেও মুক্তিযুদ্ধে স্বামীর অবদানের স্বীকৃতির সেই চিঠি নিয়ে তিনি আজও গর্ব অনুভব করেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার খসরু জানান, সেদিন গোপালপুর উপজেলার মাহমুদ-পুর গ্রামে ১৪ জন এবং পানকটা গ্রামে তিন জন শহীদ হন। শহীদদের মধ্যে পানকটা গ্রামের রমযান ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের স্বেচ্ছাসেবক। স্ত্রী ও দুই সন্তানের সংসারে দিনমজুর রমযানের  ছিল শুধু বসতভিটা। স্বামী হারানোর পর দুই অবুঝ সন্তান নিয়ে ইফাতনের তাই শুরু হয় কষ্টের দিনাতিপাত। কিছুদিন ঝিয়ের কাজ করেছেন। এরপর অসুখ ও বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে পড়েন ইফাতন। বর্তমানে বিধবা মেয়ে ও গাজিপুরে লেবারের কাজ করা ছেলে কেউই তার খোঁজ রাখেন না।

গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার পারভেজ মল্লিক জানান, একজন শহীদের স্ত্রী ভিক্ষা করেন বা অনাহারে থাকেন, এমন খবর বেদনাদায়ক। মাহমুদপুর গণহত্যা স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ফলকে যে সতের শহীদের নাম উত্কীর্ণ করা হয়েছে রমযান তাদের একজন। ইফাতনের এমন দুরবস্থার কথা জানা ছিল না। পানকাতা গ্রাম এখন ধনবাড়ী উপজেলাধীন হলেও গোপালপুর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তাকে সহায়তা দেওয়া হবে। 

বলিভদ্র ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য আমিনুল ইসলাম জানান, খাবার কষ্ট দেখে গত বছর তাকে বয়স্ক ভাতার কার্ড দেওয়া হয়। মাসে ৫০০ টাকার ভাতায় দুই বেলা খাবারই জোটে না। ডাক্তার, ওষুধ ও কাপড়-চোপড় তো দুরস্ত।

তিনি বলেন, গ্রামের স্কুলমাঠে জনসভা হয়। সেখানে নেতারা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার কথা বলেন। কিন্তু শহীদ রমযান আলীর নিরন্ন পরিবারের খোঁজ নিতে কেউ আসেন না। একজন শহীদের স্ত্রী ভিক্ষা করে খায়, এক বেলা খেয়ে তিন বেলা উপোস করে এমন লজ্জা ও দায় সবার।

পড়শি কল্পনা বেগম জানান, বঙ্গবন্ধু ৫০ বছর আগে চিঠি ও ২ হাজার টাকা অনুদান দিয়ে শহীদের স্ত্রী হিসেবে ইফাতনকে সম্মানিত করেছিলেন। কিন্তু তারপর কোনো সরকারই অকাল বিধবা ইফাতনের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসেননি।

আরেক পড়শি মিনারা বেগম জানান, দিনমজুর ছেলে ইফাতনের খোঁজখবর রাখেন না। রোগে-শোকে, অপুষ্টিতে তিনি এখন চলত্শক্তিরহিত। থাকার ঘরটি ভাঙাচোরা। চাল চুয়ে পানি পড়ে। একাত্তরে কপাল ভাঙা ইফাতনের নিয়তি সারা জীবনই উপহাস করেছে। 

ধনবাড়ী উপজেলার বলিভদ্র ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম জানান, ইফাতন বেওয়ার দুঃসহ জীবনের কথা শুনে তিনি ব্যথিত। ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ধনবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসলাম হোসাইন জানান, তিনি নতুন এসেছেন। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।


সর্বশেষ সংবাদ